বাপেক্সের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে শ্রীকাইল, মোবারকপুর ও ফেঞ্চুগঞ্জের প্রকল্পটি; লক্ষ্য নিজস্ব উৎপাদন বৃদ্ধি ও আমদানি নির্ভরতা হ্রাস
বিশেষ প্রতিবেদক, ঢাকা: অভ্যন্তরীণ জ্বালানি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ব্যয়বহুল আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে সরকার ১,১৩৬ কোটি টাকার একটি বিশাল প্রকল্প অনুমোদন করেছে। এর আওতায় দেশজুড়ে তিনটি নতুন অনুসন্ধান গ্যাস কূপ খনন করা হবে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অধীন পেট্রোবাংলার সহযোগী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। এর লক্ষ্য হলো ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে দেশের দ্রুত হ্রাসমান গ্যাস মজুদের ওপর চাপ কমানো।
প্রকল্পের স্থান ও অর্থায়ন
প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুসারে, তিনটি কূপ হলো— শ্রীকাইল ডিপ-১, মোবারকপুর ডিপ-১ এবং ফেঞ্চুগঞ্জ সাউথ-১। এগুলো যথাক্রমে চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং সিলেট বিভাগের তিনটি ভিন্ন উপজেলায় খনন করা হবে।
- মোট প্রকল্প ব্যয়: ১,১৩৬ কোটি টাকা।
- সরকারি ঋণ: ৯০৯ কোটি টাকা।
- বাপেক্সের নিজস্ব তহবিল: ২২৭.২৫ কোটি টাকা।
এই প্রকল্পটি ২০২৫ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে ২০২৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
সম্ভাব্য গ্যাস মজুদ ও উত্তোলনযোগ্য পরিমাণ
কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, খননকাজ সফল হলে এবং বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মজুদের সন্ধান মিললে এই তিনটি কূপ সম্মিলিতভাবে আনুমানিক ১,৬৯৬.৩৬ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ) গ্যাস যোগ করতে পারে। পরিকল্পনা কমিশন মূল্যায়ন করেছে যে, এর মধ্যে প্রায় ১,০১৮.১৪ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলনযোগ্য হবে, যা দেশের গ্যাস মজুদের ভিত্তিকে উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী করবে।
এ লক্ষ্যে শ্রীকাইল ডিপ-১ এবং মোবারকপুর ডিপ-১ কূপ দুটি ৬,০০০ মিটার গভীরতায় এবং ফেঞ্চুগঞ্জ সাউথ-১ কূপটি ৪,০০০ মিটার গভীরতায় খনন করা হবে। থ্রি-ডি সিসমিক জরিপের ফলাফল এবং ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে স্থানগুলো চূড়ান্ত করা হয়েছে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টার অভিমত
১ ডিসেম্বর একনেক সভার পর পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “এই নতুন কূপগুলি থেকে গ্যাস অবিলম্বে পাওয়া যাবে না, কিন্তু ভবিষ্যতের তীব্র ঘাটতি এড়াতে এই পদক্ষেপগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” তিনি আরও জানান, সরকার বাপেক্সকে শক্তিশালী করতে এবং পরবর্তী আহরণ পর্যায়ের জন্য প্রয়োজনীয় ড্রিলিং সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি সংগ্রহের ব্যবস্থা নিয়েছে। এটি বাপেক্সের ২০টি নতুন কূপ খননের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের অংশ।
চলমান গ্যাস সংকট ও আমদানির চাপ
বর্তমানে বাংলাদেশ একটি তীব্র গ্যাস সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরবরাহ হ্রাস, রক্ষণাবেক্ষণের সমস্যা এবং শীতকালে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সারা দেশে গৃহস্থালী রান্না, শিল্প উৎপাদন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে।
- ঘাটতি: কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে বর্তমানে দৈনিক প্রায় ৪০০-৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি) গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে।
- ভোক্তাদের দুর্ভোগ: ঢাকা ও অন্যান্য প্রধান শহরের আবাসিক এলাকা, বিশেষত মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাসাবো এবং উত্তরা-এর কিছু অংশে, গ্যাস সরবরাহ অস্বাভাবিকভাবে কম থাকায় বহু পরিবারকে বিকল্প ব্যয়বহুল জ্বালানি যেমন এলপিজি সিলিন্ডার বা ইলেকট্রিক চুলায় নির্ভর করতে হচ্ছে।
- শিল্প খাতে প্রভাব: গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং নরসিংদীর শিল্পাঞ্চলগুলোতেও উৎপাদন হ্রাসের খবর পাওয়া গেছে।
এই সংকট সামাল দিতে সরকার আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) আমদানি করছে। গত আগস্ট ২০২৪ থেকে প্রায় ৭,৫০০ কোটি টাকা মূল্যের ১৫টি এলএনজি কার্গো সংগ্রহের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে জ্বালানি কর্মকর্তারা সতর্ক করেছেন যে, স্পট মার্কেট থেকে আমদানি জরুরী চাহিদা মেটালেও আন্তর্জাতিক এলএনজি মূল্যের অস্থিরতার কারণে দেশ ঝুঁকিতে পড়ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান কাজ দ্রুত না বাড়ালে এবং মজুদ ও বিতরণ ক্ষমতা বৃদ্ধি না করা হলে আমদানি করা এলএনজির ওপর দেশের নির্ভরতা এবং বৈশ্বিক বাজারের ওঠানামার প্রভাব বাংলাদেশকে ক্রমাগত জ্বালানি সংকটের ঝুঁকিতে রাখবে।