বুধবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৫
সর্বশেষ:
খালেদা জিয়াকে ভিভিআইপি ঘোষণার সিদ্ধান্ত ডিভাইস শিল্পের বিনিয়োগ সুরক্ষা দেবে সরকার : ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বাজারে আসছে নতুন ৫০০ টাকার নোট, বৃহস্পতিবার থেকেই পাওয়া যাবে জননিরাপত্তা জোরদারে ডিজিটাল ও কমিউনিটি কৌশল গ্রহণের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের বাংলাদেশ আমদানি বন্ধ রাখায় বিপাকে ভারত, সীমান্তে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজি ২ রুপিতে! দেশের অর্থনীতি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছায়নি, কাজ করার সুযোগ আছে: বাণিজ্য সচিব অবৈধ মাছ ধরা বন্ধে বৈশ্বিক সহযোগিতা জরুরি: মৎস্য উপদেষ্টা বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরির তাগিদ ইইউর শাহরুখ খানের মার্কশিট ভাইরাল: কোন বিষয়ে কত নম্বর পেয়েছিলেন বলিউড বাদশা?

‘অপেক্ষা-চক্রে’ বাংলাদেশের অর্থনীতি, সংকট কাটাতে বিশেষজ্ঞদের দাবি অবাধ নির্বাচনের

বিশেষ প্রতিবেদক, ঢাকা:

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং বিনিয়োগের স্থবিরতার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক ভয়াবহ ‘অপেক্ষা-চক্রে’ (Waiting Vortex) আটকা পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই স্থবিরতা কাটিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হলে অবিলম্বে একটি বিশ্বাসযোগ্য অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন অপরিহার্য।

আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে (যা আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা) সামনে রেখে দেশের ব্যবসায়িক ও নীতি-নির্ধারণী মহলে এই বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে যে, অর্থনীতি বর্তমানে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, কিন্তু হাঁটতে পারছে না’। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বিনিয়োগ কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা একযোগে জানাচ্ছেন যে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিশ্চিত পরিবেশ ছাড়া নতুন উদ্যোগ বা বিনিয়োগ অসম্ভব।

উদ্বেগজনক অর্থনৈতিক সূচকসমূহ

দেশের অর্থনীতিতে এই অপেক্ষার প্রভাব স্পষ্ট:

  • বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ হ্রাস: বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিকের প্রায় অর্ধেক কমে প্রায় ৬.শতাংশে নেমে এসেছে, যা নতুন ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও উদ্যোক্তা উদ্যোগে তীব্র সংকোচনের ইঙ্গিত দেয়।
  • মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে পতন: ভবিষ্যতের শিল্প উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের অন্যতম সূচক মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ২৫ শতাংশ কমে যাওয়ায় আসন্ন উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
  • মুদ্রাস্ফীতি সঞ্চয়ে আঘাত: ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৮.৩৬ শতাংশে পৌঁছেছে, যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে আঘাত করছে। এর ফলস্বরূপ, জাতীয় সঞ্চয়পত্রের বিক্রি ৬,০০০ কোটি টাকারও বেশি কমে গেছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, অনেক নাগরিক সঞ্চয় ভেঙে জীবনধারণ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
  • বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা: চলতি অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) ২২ শতাংশ কমেছে, কারণ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা সতর্ক অবস্থান বজায় রেখেছেন—এমনকি কিছু বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রমও সঙ্কুচিত করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমির, রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (REHAB) সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভূঁইয়া, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (BGMEA) সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট ইনামুল হক খান, বাংলাদেশ চেম্বার অফ ইন্ডাস্ট্রিজের (BCI) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরি  এই প্রতিনিধিকে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন।

অর্থনীতিবিদরা জোর দিয়ে বলেছেন, অর্থনীতি রাজনৈতিক আস্থার ওপর নির্ভরশীল এবং এই আস্থা পুনরুদ্ধার করা সরকারের দায়িত্ব। একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ ছাড়া অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে না।

আন্তর্জাতিক মহলের সতর্কতা

দেশের উন্নয়ন অংশীদাররাও একই ধরনের মনোভাব প্রকাশ করেছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) তাদের ৪.বিলিয়ন ডলার ঋণের পরবর্তী কিস্তি ছাড়ের বিষয়টি একটি নির্বাচিত সরকার গঠনের সঙ্গে যুক্ত করেছে বলে জানা গেছে। একইভাবে, দেশি-বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীই ঝুঁকি নিতে অনিচ্ছুক এবং একটি সতর্ক দেখুন অপেক্ষা করুন’ (wait-and-see) নীতি গ্রহণ করছেন।

 সামাজিক মূল্য ও বেকারত্বের ঝুঁকি

অর্থনৈতিক স্থবিরতা সমাজে গভীর প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব আরও খারাপ হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছেন।

অধ্যাপক তিতুমির সতর্ক করে বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি “সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে, দারিদ্র্য বাড়িয়েছে এবং আরও ৩০ লাখ মানুষকে চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দিতে পারে।” বর্তমানে দেশ একটি তীব্র বেকারত্ব সংকটের মুখোমুখি, যেখানে প্রায় ১৩ লাখ যুবক-যুবতী কর্মহীন—যাদের মধ্যে প্রতি তিনজনের একজনই বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক।

 শিল্প নেতাদের দাবি

শিল্প খাতের নেতারা দ্রুত রাজনৈতিক ও নীতিগত স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দিয়েছেন।

লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, উৎপাদন, রিয়েল এস্টেট, ব্যাংকিং এবং পরিষেবা খাতে নতুন বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।”

ইনামীুল হক খান মন্তব্য করেন, আইএমএফ এবং বিদেশি ক্রেতা-অংশীদাররা একটি অস্থায়ী সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। তিনি যোগ করেন, “আইএমএফ এবং বিদেশি স্টেকহোল্ডাররা নতুন সরকারের জন্য অপেক্ষা করছে। কেবল তখনই আস্থা ও বিনিয়োগ বাড়বে।”

 পুনরুদ্ধারের পথ

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী প্রশাসনের প্রধান কাজ হওয়া উচিত দ্রুত, বিশ্বাসযোগ্য এবং সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা, যা একটি নির্বাচিত সরকারকে দায়িত্ব নেওয়ার পথ প্রশস্ত করবে।

আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ) ইউএনবিকে বলেছেন যে, নির্বাচনের সময়রেখার বিষয়ে স্বচ্ছতা এবং একটি শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ার আশ্বাস অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত।

ড. মোস্তফা কে মুজেরি পর্যবেক্ষণ করেন যে, উচ্চ সুদের হার এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা যতক্ষণ পুঁজির প্রবাহকে সীমিত করে রাখবে, ততক্ষণ অর্থনৈতিক পরিবেশ ভঙ্গুর থাকবে।

বিশ্লেষকরা পরামর্শ দেন যে, জাতি এখন একটি “ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে” দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে হয় বর্তমান স্থবিরতা মেনে নিতে হবে, অথবা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আস্থায় নোঙর করা একটি নতুন অর্থনৈতিক মডেলের দিকে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যেতে হবে।