সম্মেলন উপলক্ষে ইকবাল ও নজরুলকে নিয়ে ৩টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন
ঢাকা : ‘জাতীয় জাগরণে ইকবাল ও নজরুল ইসলামের ভূমিকা’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী ৪র্থ আন্তর্জাতিক সম্মেলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সিনেট ভবনে জমজমাট আয়োজনের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট (বিআইআইটি) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগ-এর যৌথ উদ্যোগে ৯ ও ১০ নভেম্বর, দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, জার্মানি, তুরস্ক, ইরান, জাপানসহ মোট ২২টি দেশের প্রখ্যাত গবেষক, শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিকবৃন্দ অংশ নেন। তাঁরা মোট ১৮টি সেশনে ১২৭টি মূল্যবান গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
সম্মেলনে উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠান
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান:
৯ নভেম্বর শনিবার নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়।
- উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান।
- বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, বিআইআইটি’র মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এম. আবদুল আজিজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান।
- মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ার অধ্যাপক ড. মাহমুদুল হাসান এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. খাজা মুহাম্মদ ইকরামুদ্দিন।
সমাপনী অনুষ্ঠান:
১০ নভেম্বর রোববার ঢাবি’র উর্দূ বিভাগের প্রফেসর ড. জাফর আহমেদ ভুইয়ার সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন প্রফেসর ড. আবদুস সালাম। এ অনুষ্ঠানে কবি আবদুল হাই শিকদার, অধ্যাপক ড. এম আবদুল আজিজ, কবি জাকির আবু জাফর, সাইয়েদা আনিস ফাতিমা জাইদি (পাকিস্তান) ও সাইয়েদ সারওয়ার জাহির (জার্মানি) প্রমুখ বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
দার্শনিক ইকবাল ও বিদ্রোহী নজরুল: আত্মজাগরণের প্রতীক
বক্তারা আল্লামা ইকবাল ও কাজী নজরুল ইসলামের দার্শনিক চিন্তাধারা, সাহিত্যিক অবদান এবং জাতীয় চেতনার ভূমিকা নিয়ে গভীর আলোচনা করেন।
- ঢাবি ভিসি অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন জ্ঞানচর্চা ও মানবিক মূল্যবোধের এক অনন্য উদযাপন। তিনি জুলাই গণ-অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে বলেন, ‘জাগরণের দর্শন’ নিয়ে সম্মেলনের মূল বিষয়বস্তু তাই সময়োপযোগী ও তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি আশা করেন, ইকবাল ও নজরুলের দর্শন থেকে প্রাপ্ত বাস্তব শিক্ষা আমাদের জ্ঞানকে কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে সহায়ক হবে। তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর তাদের চিন্তা-দর্শন নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে কাজের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
- অধ্যাপক ড. এম. আবদুল আজিজ, বিআইআইটি’র মহাপরিচালক, বলেন, “ইকবাল ও নজরুল উপমহাদেশের মুসলিম আত্মচেতনা, সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ ও মানবমুক্তির দুই আলোকিত নক্ষত্র। ইকবাল ছিলেন চিন্তার বিপ্লবী, নজরুল ছিলেন হৃদয়ের বিপ্লবী।” তিনি উল্লেখ করেন, ইকবাল তার খুদি তত্ত্বে আত্মসচেতনতা, সাহস ও নৈতিকতার আহ্বান জানান, যা পরবর্তীতে পাকিস্তান আন্দোলনের দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে প্রতিফলিত হয়। অন্যদিকে, নজরুল ছিলেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ও সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর।
- মাহমুদুর রহমান, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক, বলেন, বাংলা ও উর্দু সাহিত্যের এই দুই মহত্তম কবি একই লক্ষ্য ‘মুসলিম রেনেসাঁ’র স্বপ্ন বাস্তবায়নে আজীবন লিখে গেছেন। তিনি ইকবালের ‘শিকওয়া’ ও ‘জবাব-এ-শিকওয়া’ এবং নজরুলের ‘আনোয়ার’ কবিতার মধ্যে ভাবগত মিলের দিকটি তুলে ধরে বলেন, দু’জনেই মুসলমানদের নিস্তেজতা ও আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন।
- অধ্যাপক ড. মাহমুদুল হাসান (আইআইইউএম) তার মূল প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করেন, ইকবাল ও নজরুল ন্যায়, মর্যাদা ও আত্মমর্যাদার যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা জুলাই ২০২৪-পরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক জাগরণের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। তিনি বলেন, ২০২৪-পরবর্তী বাংলাদেশের ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র ও নৈতিক শাসন প্রতিষ্ঠার পথে তাঁদের চিন্তাধারা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

৩টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ও অন্যান্য আকর্ষণ
সম্মেলন উপলক্ষে কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবাল এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ৩টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়:
- মোহাম্মদ জসিম উদ্দিনের ‘নজরুলের বিদ্রোহী: সৃষ্টি ও দৃষ্টি’।
- মোহাম্মদ জসিম উদ্দিনের ‘গুণীজনের ভাবনায় নজরুল’।
- আবদুল কাদের জিলানীর ‘মুহাম্মদ ইকবাল: বাঙালির মন ও মানসে’।
প্রকাশকরা জানান, ইকবাল ও নজরুল দু’জনেই মানবতার জাগরণ, মুক্তচিন্তা ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক; তাঁদের চিন্তার বৈশ্বিক প্রাসঙ্গিকতা ও আধুনিক প্রয়োগ স্পষ্ট।
সম্মেলনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান কবিদের অংশগ্রহণে আয়োজিত জমজমাট মুশায়েরা ও গজল সন্ধ্যা, যা উপস্থিত দর্শকদের মুগ্ধ করে।