বুধবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৫
সর্বশেষ:
খালেদা জিয়াকে ভিভিআইপি ঘোষণার সিদ্ধান্ত ডিভাইস শিল্পের বিনিয়োগ সুরক্ষা দেবে সরকার : ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বাজারে আসছে নতুন ৫০০ টাকার নোট, বৃহস্পতিবার থেকেই পাওয়া যাবে জননিরাপত্তা জোরদারে ডিজিটাল ও কমিউনিটি কৌশল গ্রহণের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের বাংলাদেশ আমদানি বন্ধ রাখায় বিপাকে ভারত, সীমান্তে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজি ২ রুপিতে! দেশের অর্থনীতি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছায়নি, কাজ করার সুযোগ আছে: বাণিজ্য সচিব অবৈধ মাছ ধরা বন্ধে বৈশ্বিক সহযোগিতা জরুরি: মৎস্য উপদেষ্টা বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরির তাগিদ ইইউর শাহরুখ খানের মার্কশিট ভাইরাল: কোন বিষয়ে কত নম্বর পেয়েছিলেন বলিউড বাদশা?

নতুন ধরনের অপরাধে ইন্ধন যোগাচ্ছে অ্যালগরিদম: কীভাবে ডিজিটাল প্রভাব বাংলাদেশে সহিংসতা ও প্রতারণা ছড়াচ্ছে?

একবিংশ শতাব্দীতে আমরা যা দেখি, পড়ি, বা বিশ্বাস করি—তার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করছে অ্যালগরিদম (Algorithm)। ডিজিটাল প্রভাব এবং অপরাধমূলক ম্যানিপুলেশনের মধ্যেকার এই রেখাটি আজ ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ফেসবুক-চালিত জনরোষ থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) দ্বারা তৈরি ডিপফেক ভিডিওর মাধ্যমে মানহানি—এসবই প্রমাণ করছে যে, অপরাধের জগতে এক নতুন ঢেউ এসেছে।

অ্যালগরিদমিক অপরাধ কী?

অ্যালগরিদমিক অপরাধ (Algorithmic Crimes) বলতে সেই ধরনের অপরাধকে বোঝায়, যা সরাসরি অ্যালগরিদম দ্বারা প্রভাবিত বা সম্ভব হয়েছে। হ্যাকিং বা ফিশিং-এর মতো গতানুগতিক সাইবার অপরাধের চেয়ে এটি ভিন্ন। অ্যালগরিদম যখন মিথ্যা তথ্য ছড়ায়, ব্যবহারকারীর আচরণে হস্তক্ষেপ করে বা পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত নেয়, যার ফলে বাস্তব জগতে ক্ষতি হয়, তখনই অ্যালগরিদমিক অপরাধ জন্ম নেয়।

বিশ্বের অপরাধবিজ্ঞানীরা এটিকে ডিজিটাল উদ্ভাবনের “অন্ধকার যমজ” (Dark Twin) হিসেবে দেখছেন। বাংলাদেশে এই ধরনের অপরাধ বর্তমানে উদ্বেগজনক উপায়ে প্রকাশিত হচ্ছে।

সহিংসতা: রংপুরের ঠাকুরপাড়া থেকে ভোলার বোরহানউদ্দিন

বাংলাদেশে অ্যালগরিদমিক অপরাধের যাত্রা শুরু হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যা তথ্যের বিস্তার দিয়ে:

  • ২০১৭, ঠাকুরপাড়া, রংপুর: একটি ভুয়া ফেসবুক পোস্ট-এর মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের গুজব ছড়ানো হয়। অ্যালগরিদমের কারণে পোস্টটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জনতা হামলা করে হিন্দু বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। পরে তদন্তে জানা যায়, পোস্টটি ছিল বানোয়াট।
  • ২০১৯, বোরহানউদ্দিন, ভোলা: ফেসবুক ব্যবহারকারীর কথিত ধর্ম অবমাননাকর বার্তার স্ক্রিনশট ভাইরাল হলে গুরুতর সংঘাতের সৃষ্টি হয়, যাতে চারজন নিহত এবং শতাধিক আহত হন। পরে দেখা যায়, ওই ব্যক্তির ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি হ্যাক করা হয়েছিল।

অ্যালগরিদমগুলো যেহেতু সংবেদনশীল (sensational) কনটেন্টকে অগ্রাধিকার দেয়, তাই এই ধরনের গুজব দ্রুত লক্ষাধিক মানুষের কাছে পৌঁছে যায় এবং বাস্তব জগতে সহিংসতা উসকে দেয়।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সিস্টেমে অনুপ্রবেশ

শারীরিক সহিংসতা ছাড়াও অ্যালগরিদমের এই কারসাজি দেশের আর্থিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করেছে:

  • আর্থিক জালিয়াতি: বিকাশ (Bkash)নগদ (Nagad)-এর মতো মোবাইল ব্যাংকিং জালিয়াতির অসংখ্য ঘটনায় স্বয়ংক্রিয় এআই বট ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই বটগুলো লেনদেন অনুমান করে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-জেনারেটেড ভয়েস ও বার্তার মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের প্রতারিত করে।
  • ডিপফেক (Deepfakes): রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের নিয়ে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ভুয়া ভিডিও বা কণ্ঠস্বর ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ছে। ডিপফেক ব্যবহার করে তাদের খ্যাতি নষ্ট করা এবং জনমতকে প্রভাবিত করা এখন একটি নতুন অপরাধমূলক কৌশল।

অপরাধবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ

অ্যালগরিদমিক অপরাধের এই উত্থানকে তিনটি প্রধান তাত্ত্বিক লেন্সের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা যায়:

১. সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব (Sociological Theory): এটি মনে করে, অপরাধ প্রায়শই সামাজিক বৈষম্য এবং দুর্বল সামাজিক ঐক্যের কারণে ঘটে। বাংলাদেশের অনলাইন জগৎ এই দুর্বল ঐক্যেরই প্রতিচ্ছবি। অ্যালগরিদমের মাধ্যমে সৃষ্ট ‘ইকো চেম্বার’-এ বিপরীত মতামত খুব কমই শোনা যায়, এবং এর ফলে মিথ্যা খবর আগুনের মতো ছড়ায়।

২. মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব (Psychological Theory): * স্ট্রেইন থিওরি: দুর্বল অর্থনীতির কারণে দ্রুত মুনাফা অর্জন করতে চাওয়া মানুষজনকে অ্যালগরিদমিক স্ক্যাম, যেমন—ভুয়া ঋণ বা ক্রিপ্টোকারেন্সি স্কিমগুলো সহজেই কাজে লাগায়। * আসক্তি: সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো ডোপামিন-চালিত প্লেজার লুপ তৈরি করে ব্যবহারকারীকে আসক্ত রাখে, যা তাদের সর্বদা ক্ষোভ এবং সংবেদনশীলতার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে।

৩. জৈবিক তত্ত্ব (Biological Theory): অ্যালগরিদম-চালিত কনটেন্টে ক্রমাগত এক্সপোজার মস্তিষ্কের পুরস্কার ব্যবস্থাকে (reward system) পরিবর্তন করতে পারে। এর ফলে নৈতিক দায়িত্ব ও অনলাইন সিমুলেশনের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে।

করণীয় ও ভবিষ্যতের পথ

অ্যালগরিদমিক অপরাধ প্রথাগত অপরাধবিজ্ঞানের ভিত্তিকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। এটি প্রমাণ করে যে, এই আধুনিক যুগে অপরাধ আর শুধু শারীরিক জগতে সীমাবদ্ধ নয়; এটি স্বয়ংক্রিয়, কোড-নির্ভর এবং এর প্রভাব প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত অদৃশ্য থাকে।

বাংলাদেশের জন্য এখন জরুরি:

  • নীতি নির্ধারক, শিক্ষাবিদ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে অ্যালগরিদমিক কারসাজিকে শুধুমাত্র ‘সাইবার সমস্যা’ হিসেবে না দেখে এটিকে একটি সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা হিসেবে দেখা।
  • এটির বিরুদ্ধে একটি দৃঢ় ও সমন্বিত নীতিগত পদক্ষেপ তৈরি করা, যা প্রযুক্তিগত সচেতনতার সঙ্গে অপরাধবিজ্ঞানের অন্তর্দৃষ্টিকে একত্রিত করবে।

এই ক্রমাগত বিপদ থেকে সমাজকে বাঁচাতে দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া অত্যাবশ্যক।

**ফাতেমা জারিন হাবিবা (আইন বিভাগের শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস)