নিজস্ব প্রতিবেদক: উত্তরবঙ্গের কোটি মানুষের জীবনরেখা তিস্তা নদী শুষ্ক মৌসুমের বহু আগেই শুকিয়ে বালুচরে পরিণত হয়েছে। ভারতের উজানে গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ করে একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলেই নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়ে এ অঞ্চলের কৃষি, মৎস্য ও জীবন-জীবিকা চরম সংকটে পড়েছে। শুষ্ক মৌসুম আসার আগেই তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানির গড় প্রবাহ দৈনিক মাত্র ১৭,০০০ কিউসেকসে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এই পরিস্থিতিতে, তিস্তার ন্যায্য হিস্যার দাবিতে ‘তিস্তা বাঁচাও, উত্তরবঙ্গ বাঁচাও’ স্লোগানে আন্দোলনে নেমেছেন স্থানীয় মানুষজন ও পরিবেশ কর্মীরা।
প্রধান সংকট ও কারণ
এক সময়ের খরস্রোতা এই নদী এখন শীতকালের আগেই ‘মৃতপ্রায়’ দশায় পৌঁছেছে। নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের গজলডোবা ব্যারাজ এবং দেশের অভ্যন্তরে লালমনিরহাটে দোয়ানি ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ বিঘ্নিত করে খাল দিয়ে পানি সরিয়ে নেওয়াই এই বিপর্যয়ের মূল কারণ। এর ফলে:
- অক্টোবরের শেষেই তিস্তা প্রায় শুকিয়ে গেছে, যা উত্তরাঞ্চলের মরুকরণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
- পাউবো কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পানির অভাবে তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পেও আসন্ন শুষ্ক মৌসুমে সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
- তিস্তার ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার জেলে ও কৃষক জীবিকা হারিয়ে ‘নদীর সঙ্গে মরার’ কথা বলছেন।
নদী ভাঙন ও বাস্তুচ্যুতি
উজানে পানি প্রত্যাহারের ফলে একদিকে শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না, অন্যদিকে বর্ষাকালে হঠাৎ অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়ায় নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে।
- পাউবোর তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে নদী ভাঙনে ২০ হাজারেরও বেশি পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
- এরই মধ্যে লালমনিরহাটের মহিপুরে তিস্তা প্রতিরক্ষা বাঁধের ৩৫০ মিটার অংশ নদীতে বিলীন হয়েছে।
- কুড়িগ্রামের উলিপুরে ১০০টিরও বেশি এবং গঙ্গাচড়া উপজলায় ৫০টিরও বেশি পরিবার ভাঙনের শিকার হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তিস্তা মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের দাবি
তিস্তা নদীর সুরক্ষা ও উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবন বাঁচাতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধার মানুষজন সম্প্রতি ৪৮ ঘণ্টার প্রচারাভিযান, মানববন্ধন ও মশাল মিছিলের মতো কর্মসূচি পালন করেছেন।
- মহাপরিকল্পনার রূপরেখা: এই মহাপরিকল্পনায় নদী খনন বা ড্রেজিং, চরবাসীর পুনর্বাসন ও বাঁধ মেরামতের কথা রয়েছে, যার প্রাথমিক ব্যয় ৮ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছিল।
- অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন: পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছেন, মোট ১২ হাজার কোটি টাকার ১০ বছর মেয়াদী এই প্রকল্পটি জানুয়ারি ২০২৬ থেকে দুই ধাপে শুরু হবে। প্রথম ধাপে ৬,৭০০ কোটি টাকা চীনা ঋণ এবং ২,৪৫০ কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে।
- তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আসাদুল হাবিব দুলু হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, নির্বাচন ঘোষণার আগে সরকারি অর্থায়নে কাজ শুরু না হলে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
নদী বিশেষজ্ঞ ড. তুহিন ওয়াদুদ সতর্ক করেছেন, বৈজ্ঞানিক উপায়ে তিস্তা খনন না করা হলে গোটা উত্তরবঙ্গ অচিরেই মরুভূমিতে পরিণত হবে। তাঁর মতে, ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারই নদীটিকে মেরে ফেলেছে এবং এখন সরকারের দায়িত্ব এটিকে বাঁচানো।