ঢাকা: তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কনটেইনার টার্মিনাল—নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), লালদিয়ার চর এবং পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল (আইসিটি)—পরিচালনার দায়িত্ব এই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে বিদেশি অপারেটরদের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার।
রোববার (১১ অক্টোবর) পুরানা পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পে বিনিয়োগ সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ এই ঘোষণা দেন।
মোহাম্মদ ইউসুফ জানান, নিউ মুরিং টার্মিনালটি অক্টোবরের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার প্রাথমিক লক্ষ্য থাকলেও, প্রক্রিয়াটি কিছুটা সময় নিচ্ছে। একইভাবে পানগাঁও হস্তান্তরেও সামান্য বেশি সময় লাগতে পারে। তবে সামগ্রিক প্রক্রিয়াটি এগিয়ে চলছে।
বিদেশি অপারেটর নিয়ে আপত্তি নাকচ চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি অপারেটর নিয়োগ নিয়ে সম্ভাব্য প্রতিরোধ বা কৌশলগত উদ্বেগের বিষয়ে নৌ সচিব তার বক্তব্য নাকচ করে দেন।তিনি বলেন, “আলোচনা শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি অপারেটরদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কৌশলগত বা ভৌগোলিক কিছু বিষয় থাকলেও, আমরা মনে করি সেগুলো বড় কোনো বাধা নয়।”
তিনি যুক্তি দেন, শ্রীলঙ্কা, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বন্দরে যখন বিদেশি অপারেটররা কাজ করছে এবং সেখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না, তখন বাংলাদেশেও সমস্যা হওয়ার কোনো কারণ নেই।সচিব ব্যাখ্যা করেন যে এই পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য হলো বন্দরের দক্ষতা ও সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো।
তিনি বন্দরের বর্তমান অপারেশনাল সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেন: “আমরা এখন এমন কিছু কাজ করছি যা বিশ্বে নজিরবিহীন, যেমন বন্দরের ভেতরে কনটেইনার খুলে পণ্য ডেলিভারি দেওয়া।
“তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩টি গেটের মধ্যে স্ক্যানিং মেশিন আছে মাত্র ছয়টি, এর মধ্যে ৩-৪টি প্রায়ই নষ্ট থাকে। এভাবে একটি বন্দর চলতে পারে না।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, বিদেশি অপারেটর নিয়োগের মাধ্যমে বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো এবং আরও বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে।স্থানীয় ব্যবসায়ীদের আপত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে সচিব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন, “তারা প্রথমে নানা কথা বললেও, একবার যখন পরিস্থিতি ও উন্নতি দেখতে পাবে, তখন আর কথা বলবে না।”
সেবার মান বাড়লে খরচ গ্রহণে সমস্যা হবে না বন্দর উন্নয়নের কারণে খরচ বাড়ানো হলে তা বহন করা সম্ভব হবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব যুক্তি দেন, সেবার মান বাড়ানো গেলে বাড়তি খরচ দিতে সমস্যা হবে না।
তিনি বলেন, “যদি সেবার মান বৃদ্ধি করা যায় এবং দ্রুত সেবা দেওয়ার মাধ্যমে বন্দরে জাহাজ বসিয়ে রেখে অযথা ডেমারেজ খরচ কমানো সম্ভব হয়, তাহলে বাড়তি খরচ দিতে কোনো সমস্যা হবে না।”
জাহাজ নির্মাণে বিশেষ ব্যাংকিং ব্যবস্থার তাগিদ বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ওশান-গোয়িং শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আজম জে চৌধুরী একই দেশে জাহাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে “দুই ধরনের পতাকার” অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
তিনি বিদ্যমান আইন নিয়েও প্রশ্ন তোলেন, যেখানে সরকারি টাকায় কেনা পণ্য শুধু ‘সরকারি পতাকাবাহী’ জাহাজ দ্বারা পরিবহনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
মূল প্রবন্ধে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জায়দী সাত্তার বলেন, দেশের জাহাজভাঙা শিল্প এবং ছোট জাহাজ নির্মাণ ইতোমধ্যে বড় আকারের জাহাজ নির্মাণের ভিত্তি তৈরি করেছে।তিনি জানান, বর্তমানে জাহাজ রপ্তানির জন্য বাংলাদেশের কাছে কয়েক শত মিলিয়ন ডলারের কার্যাদেশ রয়েছে।
ড. সাত্তার এই শিল্পকে আরও শক্তিশালী করতে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের উপযোগী একটি বিশেষায়িত ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ড. সাত্তার উপসংহারে বলেন, “জাহাজ নির্মাণ শিল্প আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব বাণিজ্যের বর্তমান ইতিবাচক ধারা কাজে লাগাতে পারলে এই শিল্পকে ২ বিলিয়ন ডলারের শিল্পে পরিণত করা সম্ভব।”
তিনি মনে করেন, এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রেক্ষাপটে দেশকে এমন শিল্পের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে, যা তৈরি পোশাক নির্ভরতার বাইরে একটি টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফ সভাপতি দৌলত আকতার মালা এবং অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।