ঢাকা : বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সৌদি আরব থেকে দেশে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স পাঠানোর তুলনামূলক উচ্চ খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে দুই দেশের আর্থিক খাতকে যৌথভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার বনানীর একটি হোটেলে ‘সৌদি আরব-বাংলাদেশ বিজনেস সামিট ২০২৫’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে গভর্নর মনসুর বলেন, সৌদি আরব বাংলাদেশের জন্য রেমিট্যান্সের বৃহত্তম উৎস এবং এটি বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা।
তিনি বলেন, “সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেশি। প্রবাসীরা মোট অর্থের ৬ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ দিয়ে থাকেন, যা তাদের জন্য বিশাল বোঝা।”গভর্নর আরও দক্ষ ও কম খরচের অর্থ স্থানান্তর ব্যবস্থার জরুরি প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে বলেন, এই লক্ষ্য অর্জনে দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো একসাথে কাজ করতে পারে।
অর্থনীতির স্থিতিস্থাপকতা ও বিনিয়োগ আহ্বান ড. মনসুর বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান আকার অর্ধ ট্রিলিয়ন ডলার উল্লেখ করে ট্রিলিয়ন-ডলারের অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ একটি উল্লেখযোগ্যভাবে স্থিতিশীল রাষ্ট্র। প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক এবং বৈশ্বিক নানা ধাক্কা সত্ত্বেও আমাদের প্রবৃদ্ধি কখনোই নেতিবাচক হয়নি। গত ৩০ বছরে আমাদের প্রবৃদ্ধি কখনও ৩.৫% -এর নিচে নামেনি।” তিনি সৌদি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার আহ্বান জানান।
সৌদী আরব বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (SABCCI) আয়োজিত এই সম্মেলনে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।খসরু বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বড় আকারের তহবিলের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো পুঁজিবাজারকে **’ফ্রন্টিয়ার ইকোনমি’ থেকে ‘ইমার্জিং মার্কেট’-এ উন্নীত করা। এই পরিবর্তনে সৌদি তহবিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।” তিনি আরও যোগ করেন, এই সহযোগিতা কেবল প্রচলিত জ্বালানি ও টেক্সটাইল খাতের বাইরেও প্রসারিত হওয়া উচিত।
বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিকল্পনা স্বাগত বক্তব্যে SABCCI-এর সভাপতি আশরাফুল হক চৌধুরী ৫৩ বছর পর দুই দেশের মধ্যে প্রথম যৌথ ব্যবসায়িক চেম্বার গঠনের কথা জানান।তিনি তৈরি পোশাক (RMG), কৃষি পণ্য, আইটি পরিষেবা এবং দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশে অবকাঠামো, লজিস্টিকস এবং আইটি খাতে সৌদি বিনিয়োগ বাড়াতে কাজ করার পরিকল্পনা তুলে ধরেন।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের বিশাল সম্ভাবনা অনুষ্ঠানে গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জ-এর চেয়ারম্যান ড. এম. মাসরুর রিয়াজ একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিশাল, অব্যবহৃত সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন।
তিনি উল্লেখ করেন, বর্তমানে কোনো দেশই একে অপরের শীর্ষ পাঁচটি বাণিজ্য অংশীদারের তালিকায় নেই, যা সম্প্রসারণের ব্যাপক সুযোগ নির্দেশ করে।
রিয়াজ বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসেবে আরএমজি, প্রক্রিয়াজাত কৃষি পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, জুতা, প্লাস্টিক পণ্য এবং ওষুধকে চিহ্নিত করেন। অন্যদিকে, সৌদি আরব খনিজ ও রাসায়নিক পণ্য, এলএনজি, সার, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং লজিস্টিকস খাতে রপ্তানি ও বিনিয়োগ বাড়াতে পারে।তিনি মানবসম্পদ উন্নয়নকেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে তুলে ধরেন।
বর্তমানে সৌদি আরবে প্রায় ২১ লাখ বাংলাদেশি কর্মরত থাকলেও তাদের মধ্যে মাত্র ২২ শতাংশ দক্ষ শ্রমিক। রিয়াজ পরামর্শ দেন যে সৌদি প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিকের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো সম্ভব, যা উভয় অর্থনীতির জন্য বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করবে।
প্রদর্শনী ও প্রতিনিধিদল ব্যবসায়িক সম্মেলন উপলক্ষে ২০টি বাংলাদেশি কোম্পানির পণ্য ও পরিষেবা প্রদর্শনীতে স্থান পায়। এটিই বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম সৌদি আরব-বাংলাদেশ বিজনেস সামিট। সৌদি আরবের ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল প্রদর্শনী পরিদর্শন করে এবং সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ ও বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন।