ঢাকা : বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) ব্যয় গত এক দশকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকগুলো সম্মিলিতভাবে সিএসআর খাতে মাত্র ১৫.৫৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছে, যা গত ছয় মাসের ব্যয় (৩০৭ কোটি টাকা) এর অর্ধেকেরও কম। এই ব্যাপক পতন ব্যাংকিং খাতের সামাজিক প্রতিশ্রুতি এবং তহবিলের সঠিক ব্যবহার নিয়ে নতুন প্রশ্ন তৈরি করেছে।
দশকের সর্বনিম্ন ব্যয়
এই পরিমাণ গত দশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। এমনকি ২০১৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ব্যয় হওয়া ২৫৪ কোটি টাকার থেকেও এটি অনেক কম। এই নিম্নমুখী প্রবণতা ব্যাংকিং খাতের কার্যক্রমে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিএসআর ব্যয়ে ব্যাপক ওঠানামা ছিল। ২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে যেখানে ব্যয় ছিল প্রায় ২৯৮ কোটি টাকা, সেটি ২০২২ সালের একই সময়ে বেড়ে ৫১৪ কোটি টাকায় পৌঁছায়। এরপর ২০২৩ সালের শেষ ছয় মাসে তা কমে ৩৫৩ কোটি টাকায় আসে। এই বছর হঠাৎ করে ১৫.৫৬ কোটি টাকায় নেমে আসার পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে জুলাইয়ের রাজনৈতিক আন্দোলন এবং আগস্টে সরকারের পরিবর্তনকে দায়ী করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্তি
ব্যাংকারদের মতে, পূর্ববর্তী রাজনৈতিক সরকারের আমলে ব্যাংকগুলো সিএসআর খাতে ব্যয় করার জন্য চাপের মুখে ছিল। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, স্থানীয় প্রতিনিধি বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনুরোধে প্রায়শই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা অনুদানে অর্থ বরাদ্দ করতে বাধ্য করা হতো। এই ব্যয় অনেক সময়ই প্রকৃত সামাজিক দায়িত্বের আওতার বাইরে ছিল। কিন্তু জুলাইয়ের রাজনৈতিক আন্দোলনের পর এবং আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর সেই চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। ফলে, ব্যাংকগুলো এখন বাধ্যবাধকতার পরিবর্তে নিজেদের বিবেচনা অনুযায়ী সিএসআর তহবিল ব্যয় করছে, যা ব্যয়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে।
অনিয়মিত খাত ভিত্তিক ব্যয়
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মোট সিএসআর বাজেটের ৩০ শতাংশ শিক্ষায়, ৩০ শতাংশ স্বাস্থ্যে এবং ২০ শতাংশ পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ব্যয় করা বাধ্যতামূলক। বাকি ২০ শতাংশ আয়বর্ধক উদ্যোগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, খেলাধুলা এবং অন্যান্য খাতে ব্যয় করা যেতে পারে। তবে প্রতিবেদন অনুযায়ী, আলোচ্য সময়ে ৬১টি তফসিলি ব্যাংক এই নির্দেশনা উপেক্ষা করে “অন্যান্য” খাতে মোট ব্যয়ের ৫৫ শতাংশ (৮৩ কোটি টাকা) ব্যয় করেছে। শিক্ষায় মাত্র ২২.৭৫ শতাংশ (৩৪.২৫ কোটি টাকা), স্বাস্থ্যে ১৮.৬৭ শতাংশ (২৮.১২ কোটি টাকা) এবং পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন খাতে মাত্র ৩.৪৬ শতাংশ (৫.২১ কোটি টাকা) ব্যয় করা হয়েছে।
সিএসআর ব্যয়হীন ১৩ ব্যাংক
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, আলোচ্য সময়ে ১৩টি ব্যাংক কোনো সিএসআর ব্যয় করেনি। এই ব্যাংকগুলো হলো: জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক, এসবিএসসি, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব
একজন বেসরকারি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আগে রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইচ্ছানুসারে সিএসআর বাজেট ব্যবহার করা হতো। বাইরে থেকে সিদ্ধান্ত আসত কাকে এবং কোথায় দিতে হবে। এখন সেই চাপ নেই। ব্যাংকগুলো নিজেদের বিচার-বিবেচনা অনুযায়ী খরচ করছে, তাই ব্যয় অনেক কমে গেছে।”
অর্থনীতিবিদ ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, সিএসআর ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকা জরুরি। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক প্রভাব প্রায়শই এই তহবিলগুলোকে অনুৎপাদনশীল খাতে সরিয়ে নেয়, যা ব্যাংকের সামাজিক দায়িত্বের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে।