বুধবার ২৩ জুলাই, ২০২৫
সর্বশেষ:
বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের প্রায় ৭৫% পাচার হয়েছে বাণিজ্য ভুল চালানের মাধ্যমে: BIBM সমীক্ষা ঐতিহাসিক জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রথমবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ঢাবি চারুকলা অনুষদে সেমিনার ও শিল্পকর্ম প্রদর্শনী জুলাই মাসের ২১ দিনে বাংলাদেশ ১.৭০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়-এর একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম-এরশিক্ষার্থীদের ডিএসই পরিদর্শন মার্কিন ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ: বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে অনিশ্চয়তা একিউআর পদ্ধতি ৬টি ইসলামী ব্যাংকের লুকানো খেলাপি ঋণের পরিমাণ আগের তুলনায় ৪ গুণ বেশি খুঁজে পেয়েছে মার্কিন পাল্টা শুল্ক আলোচনায় বাংলাদেশের বাস্তবসম্মত ও কৌশলগত প্রস্তুতি প্রয়োজন: ড. সেলিম রায়হান, সানেম এর নির্বাহী পরিচালক বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা তুলে ধরতে চীনে সরকারি প্রতিনিধি দল ২০২৫ সালের জানুয়ারি-মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ২১.৬% বৃদ্ধি পেয়েছে

মার্কিন ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ: বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে অনিশ্চয়তা

ঢাকা, ২২ জুলাই – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সকল আমদানিকৃত পণ্যের উপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ায় দেশের উৎপাদন খাতে অনিশ্চয়তা বেড়ছে।1 আগামী ১ আগস্ট, ২০২৫ থেকে এই শুল্ক কার্যকর হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। এটিকে বাণিজ্য উত্তেজনার একটি উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং এটি বাংলাদেশের রপ্তানি-নির্ভর অর্থনীতি, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতের উপর গুরুতর প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এই নতুন শুল্ক, যা পূর্বে প্রস্তাবিত ৩৭ শতাংশ থেকে সামান্য কম হলেও, পূর্বের গড় ১৫ শতাংশের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।2 এটি বাংলাদেশকে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী যেমন ভিয়েতনামের (যাদের উপর ২০ শতাংশ কম শুল্ক আরোপ করা হয়েছে বলে জানা গেছে) তুলনায় প্রতিকূল অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।

তৈরি পোশাক খাতে ভয়াবহ প্রভাব

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প, যা দেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি এবং জিডিপির প্রায় ৮ শতাংশের জন্য দায়ী, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।3 মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের একক বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য, যেখানে বার্ষিক প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের বাংলাদেশি পণ্য (যার মধ্যে ৬ বিলিয়নের বেশি পোশাক) আমদানি করা হয়। এই বর্ধিত শুল্ক মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি বস্ত্রের দাম নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে দেবে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এর ফলে চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে, কারখানায় উৎপাদন কমে যেতে পারে এবং এই খাতে নিযুক্ত প্রায় ৪০ লাখ মানুষের ব্যাপক কর্মচ্যুতি হতে পারে।4

মুডি’স অ্যানালিটিকসের এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক্সের পরিচালক ও প্রধান ক্যাটরিনা এল বলেছেন, “এটি ধ্বংসাত্মক হবে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ২০ শতাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যায়।

বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া ও চলমান আলোচনা

এই প্রতিক্রিয়ায়, বাংলাদেশ সরকার একটি কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, যেখানে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান ওয়াশিংটন ডিসিতে আলোচনার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে, গম, তুলা, এলএনজি এবং সয়াবিনের মতো আমেরিকান পণ্যের শুল্কমুক্ত আমদানি বাড়ানোর মতো বেশ কয়েকটি ছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছে।

এদিকে, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিতে সম্ভাব্য শুল্ক বৃদ্ধি মোকাবেলায় মার্কিন লবিস্ট নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত সরকারের আলোচনার অগ্রগতির বিষয়ে শিল্পের উদ্বেগকে প্রতিফলিত করে।

বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় বাজার, তাই শুল্ক যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে কমাতে সরকারকে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বিজিএমইএ মার্কিন বাণিজ্য নীতিকে প্রভাবিত করতে এবং মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পোশাক প্রস্তুতকারকদের স্বার্থ রক্ষা করতে চায়।

তিনি আরও বলেন, লবিস্ট নিয়োগ একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং এর জন্য কিছু সময় প্রয়োজন। সরকার ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আকর্ষণীয় কিছু প্রস্তাব পাঠিয়েছে, যার মধ্যে মার্কিন তুলার জন্য বন্ডেড ওয়্যারহাউসও রয়েছে।

বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “শুল্ক কমানো বা বাংলাদেশের জন্য নতুন শুল্ক আরোপের সময়সীমা বৃদ্ধি, সব বিষয়ই মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপর নির্ভর করছে। তাই শুল্ক কমানো না হলে আমাদের বিকল্প পথ খুঁজে বের করতে হবে।”

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রাক্তন প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, মার্কিন বাজারে পোশাকের শুল্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছু দেশের চেয়ে এগিয়ে থাকবে আবার কিছু দেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকবে। তিনি আরও বলেন, “যেহেতু বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনার অধীনে রয়েছে, তাই অন্যান্য দেশের জন্য শুল্ক এখনো নির্ধারিত হয়নি। তাই, আমাদের অবস্থান কী হবে তা জানতে আরও সময় লাগবে।”

তিনি মনে করেন, “যদি বাংলাদেশ ৩৫ শতাংশ শুল্কের সম্মুখীন হয়, যখন ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা কম শুল্কের সম্মুখীন হয়, তাহলে আমরা (বাংলাদেশ) মার্কিন বাজারে আমাদের বিদ্যমান রপ্তানি ভলিউমের ২০ শতাংশ হারাব।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের (বিবি) প্রাক্তন প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে তার অভিযোজন বাড়ানোর উপর অগ্রাধিকার দিতে হবে, যা মার্কিন পণ্যের অভ্যন্তরীণ বাজারে অবাধ সুবিধা দেওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান বাণিজ্য নীতি স্থির নয় এবং স্থিতিশীল নয়, কারণ দেশটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) কর্তৃক নির্ধারিত বাণিজ্য ব্যবস্থা ক্রমাগত লঙ্ঘন করছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ইউএনবিকে বলেন, বাংলাদেশকে মার্কিন ক্রেতাদের প্রভাবিত করতে হবে যারা দেশের (বাংলাদেশ) পোশাক শিল্পের উপর ভিত্তি করে তাদের বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা তৈরি করেছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় আমদানির বিরোধিতা করেন, যা অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল হবে। বরং মার্কিন ক্রেতা এবং কৃষকরা বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে পারে, কারণ তাদের পণ্য (তুলা) পোশাক খাতে ব্যবহৃত হয়।

অনিশ্চয়তা ও ভবিষ্যৎ পথ

বাংলাদেশের রপ্তানি অর্থনীতির জন্য তাৎক্ষণিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত রয়ে গেছে। যদিও কিছু শীর্ষ রপ্তানিকারক মনে করেন যে ৩৫ শতাংশের অঙ্কটি একটি দর কষাকষির কৌশল এবং শেষ পর্যন্ত এটি কমে যাবে, তবে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলেছেন যে এর ফলাফল অন্যান্য প্রধান পোশাক রপ্তানিকারক যেমন চীন, ভারত এবং পাকিস্তানের উপর আরোপিত সংশ্লিষ্ট শুল্কের উপর নির্ভর করবে।

বাংলাদেশের জন্য, এই শুল্কগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়িয়ে তার রপ্তানি বাজারকে বৈচিত্র্যময় করার এবং ইইউ, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো অঞ্চলে নতুন সুযোগ অন্বেষণ করার জন্য একটি জরুরি সতর্কবার্তা। শিল্প বিশেষজ্ঞরা আরও উচ্চমূল্যের পণ্য উৎপাদনে স্থানান্তর, শক্তিশালী সরকার-থেকে-সরকার কূটনীতির মাধ্যমে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আকৃষ্ট ও ধরে রাখতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছেন। এই জটিল বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিস্থিতিতে কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর এখন জোর দেওয়া হচ্ছে।