ব্যাংকিং খাতে অনৈতিক চর্চা প্রত্যাখ্যানের স্বাধীনতা ফিরেছে: ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার
ঢাকা : আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা এবং ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাংকের নীতি নির্ধারণী পদ, এমনকি চেয়ারম্যান পদেও পেশাদার, যোগ্য ও বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়োগের ওপর জোর দিয়েছেন বক্তারা। তারা বলেছেন, ব্যাংকের পরিচালকদের নিজেদেরকে ‘মালিক’ নয়, বরং সাধারণ আমানতকারীদের অর্থের ‘অভিভাবক ও উদ্যোক্তা’ হিসেবে বিবেচনা করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে, যা ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক হবে।
শনিবার রাজধানীর মালিবাগে ইউএনবি সংবাদ সংস্থার কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং সংকট: সামনের পথ খোঁজা’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) অধ্যাপক নেহাল আহমেদ এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) পরামর্শক (ঝুঁকি বিশ্লেষক ইউনিট) এমজিকে জুয়েল যৌথভাবে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স বিভাগের চেয়ারম্যান মো. শহিদুল ইসলাম জাহিদ, বিইউবিটি’র অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহবুব আলী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আব্দুল মান্নান, সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খান, ইসলামী ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এম কামাল উদ্দিন জসিম, সিনিয়র সাংবাদিক সালাউদ্দিন বাবলু, ইসলামী ব্যাংকের এফএভিপি শেখ মো. রিয়াজ উদ্দিন এবং বিজনেস জার্নালিস্ট ফরহাদ হোসেন তালুকদার প্যানেল আলোচক হিসেবে অংশ নেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইউএনবি’র সম্পাদক মাহফুজুর রহমান।
ডেপুটি গভর্নরের বার্তা: স্বাধীনতা ও আশাবাদ প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার বলেন, পূর্ববর্তী সরকারের আমলে ব্যাংকিং খাতে যা ঘটেছে তা এখন আর গোপন কিছু নয়। তবে বর্তমানে ব্যাংকিং খাত যেকোনো পক্ষপাতমূলক ও অনৈতিক চর্চা প্রত্যাখ্যান করার মতো স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে, যা সুশাসন নিশ্চিতের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।
পাঁচটি ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করার বিষয়ে তিনি বলেন, সংকটাপন্ন পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য এটি একটি ‘ভালো বিকল্প’। তিনি যুক্তি দেন, “ব্যাংকগুলোকে অবসায়ন (Liquidation) করা হলে ব্যাংকিং খাতের জন্য খারাপ বার্তা যাবে। আর এই ব্যাংকগুলো কয়েক বছর আগেও ভালো চলছিল, তাই আমানতকারীরা এখানে টাকা রেখেছেন, এখন তাদের সেই টাকা ফেরত পাওয়ার অধিকার রয়েছে।”
তিনি আরও জানান, বর্তমান একীভূতকরণ স্কিমের অধীনে এই পাঁচটি ব্যাংকের প্রায় ৯০ শতাংশ আমানতকারী তাদের অর্থ ফেরত পাবেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে রাষ্ট্র, আমানতকারী, বিনিয়োগকারী এবং ব্যাংকসহ সকলের স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে। ডেপুটি গভর্নর আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, সকল চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে, তাই মানুষের নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বাংলাদেশ ব্যাংক) ওপর আস্থা রাখা উচিত।

এনপিএল বৃদ্ধি ও আর্থিক বৈষম্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আব্দুল মান্নান বলেন, ২০০৮ সালে যেখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২,০০০ কোটি টাকা, সেখানে সুশাসনের অভাবে তা এখন প্রায় ৫.০ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ব্যাংকগুলো যে নিয়ম মেনে পরিচালনার লাইসেন্স পেয়েছে, সেখানে ঋণ বিতরণ ও পুনরুদ্ধারে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো কেন হস্তক্ষেপ করবে?
সিপিডি’র তৌফিকুল ইসলাম খান উল্লেখ করেন, অনেক খারাপ ব্যাংক এখন ভালো ব্যাংকে পরিণত হয়েছে এবং দেশের শীর্ষ লাভজনক পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে নাম লিখিয়েছে। এটি কেবল ব্যাংকের কার্যক্রমে পেশাদারিত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় সম্ভব হয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, একটি ব্যাংকের বোর্ড যখন পরিচালনার জন্য নির্ধারিত ব্যবস্থার অধীনে ব্যাংক পরিচালনা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে, তখন সেখানে খেলাপি ঋণ বাড়তে পারে না এবং একীভূতকরণের প্রয়োজনও হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদুল ইসলাম জাহিদ বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যার মাত্র ২০ থেকে ২২ শতাংশ ব্যাংকিং পরিষেবার আওতায় রয়েছে, অর্থাৎ প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ আনুষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বাদ রয়েছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত না করে সত্যিকার অর্থে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সম্ভব নয়।
তিনি অভিযোগ করেন, “আমাদের বর্তমান ব্যাংকিং কাঠামোটি প্রকৃতিগতভাবেই এক্সক্লুসিভ (বহিষ্কারক) – এটি সাধারণ মানুষের জন্য কথা বলে না। কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ছাড়া বেশিরভাগ বাণিজ্যিক ও বিদেশি ব্যাংক জনগণের জন্য ব্যাংক হতে পারেনি। তারা মূলত অলিগার্কিক স্বার্থ পূরণ করে, আমানতকে মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগীর মধ্যে কেন্দ্রীভূত করে, যা প্রায়শই গোষ্ঠীর দ্বারা অপব্যবহার করা হয়।”
সরকারের পরিকল্পনার সমালোচনা করে তিনি বলেন, পাঁচটি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংককে একীভূত করে একটি নতুন সত্তা গঠন করতে সরকার জাতীয় বাজেট থেকে ২০,০০০ কোটি টাকা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে—যা আবারো জনগণের অর্থ ব্যবহার। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “জনগণের অর্থ আগেও লুট হয়েছে; সুশাসন ও আন্তরিকতার নিশ্চয়তা ছাড়া এটি যে আর লুট হবে না, তার গ্যারান্টি কী?”
মুদ্রানীতি ও কাঠামোগত সংস্কারের দাবি অধ্যাপক মাহবুব আলী অভিযোগ করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে সমস্যা রয়েছে, কারণ এটি দেশের রাজস্ব নীতির ভিত্তিতে সেট করা হয়। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জনমুখী নীতি প্রণয়নের পরিবর্তে সরকারের জন্য ঋণ গ্রহণের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। তিনি দেশে ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে নামমাত্র সংখ্যক করদাতা থাকার কারণে সরকারের ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতা তুলে ধরেন। তিনি সকল ব্যাংক পরিচালনার জন্য অভিন্ন নিয়ম প্রবর্তন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে দ্বৈত ভূমিকা পালনের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে বিলুপ্ত করার দাবি জানান।