নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা: বাংলাদেশের জ্বালানি খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে। খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়িক নেতারা সতর্ক করে বলেছেন, অবিলম্বে পদক্ষেপ না নিলে আগামী সরকারের আমলে দেশে তীব্র বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিতে পারে।
বক্তারা বলেন, “খাতটিকে স্থিতিশীল করতে এবং টেকসই বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণে দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া হলে এই সংকট দীর্ঘায়িত হবে।”বুধবার ‘পাওয়ারিং প্রসপারিটি: ক্রিয়েটিং এ স্টেবল অ্যান্ড ব্যাঙ্ক্যাবল এনার্জি ফিউচার ফর বাংলাদেশ’ (Powering Prosperity: Creating a Stable and Bankable Energy Future for Bangladesh) শীর্ষক এক বিদ্যুৎ খাত নীতি সংলাপে এই হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। পলিসি এক্সচেঞ্জ (Policy Exchange) এবং ইকোনমিক রিপোর্টার্স’ফোরাম (ERF) যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
নীতি পরিবর্তন নিয়ে উদ্বেগ ও বিশেষজ্ঞের পরামর্শআলোচকরা সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নীতি পরিবর্তনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, যা বিদেশি বিনিয়োগকে প্রভাবিত করছে। তারা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে টেকসই বিদেশি বিনিয়োগের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী নীতি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
প্যানেল আলোচনায় ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের অধ্যাপক ও উপাচার্য ড. এম. তামিম সতর্ক করে বলেন, জ্বালানি খাতের জন্য টেকসই এবং প্রয়োজনভিত্তিক বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার অভাবে আগামী সরকারকে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়তে হবে।তিনি নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন পরিকল্পনার সমালোচনা করে বলেন, এটি আমলাতান্ত্রিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা মাত্র, যার মাঠপর্যায়ে কোনো কাজ ও বাস্তবায়ন নেই।
ড. তামিম বাপেক্সের (BAPEX) সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা থাকায় সক্ষম আন্তর্জাতিক কোম্পানির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়ানোর ওপর জোর দেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (BERC) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ।প্যানেলিস্ট হিসেবে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ুং-সিক, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু, জামায়াতে ইসলামীর শুরা কাউন্সিলের সদস্য ড. মোবারক হোসেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ড. মাহদী আমিন, বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, এমসিসিআই সভাপতি কামরান টি রহমান, ডিএফডিএল-এর শাহীন নিজাম, বিডা-এর মহাপরিচালক মো. আরিফ হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক আহমেদ জুবাইর মাহমুদ, ইবিএল-এর অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ শাহীন, আইডিএসওএল-এর প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা নাজমুল হক, কনফিডেন্স পাওয়ার রংপুর লিমিটেডের চেয়ারম্যান ইমরান করিম প্রমুখ।
সংকট কেন অনিবার্য? সক্ষমতা ও চাহিদার ব্যবধানসংলাপে তুলে ধরা হয় যে, বাংলাদেশ ২০০৯ সালের ৩,৫০০ মেগাওয়াট সক্ষমতা থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে ২৮,৩৫৯ মেগাওয়াট সক্ষমতায় পৌঁছালেও, কাঠামোগত চ্যালেঞ্জগুলো এই অগ্রগতিকে হুমকির মুখে ফেলছে।
ইএমএ পাওয়ার ইনভেস্টমেন্টের পরিচালক আবু চৌধুরী বিদ্যুৎ খাতের সামগ্রিক সমস্যা ও উন্নয়ন পরিস্থিতি নিয়ে একটি পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দেন।উপস্থাপনায় আসন্ন সরবরাহ-চাহিদার ভারসাম্যহীনতার ওপর জোর দিয়ে বলা হয়, যদি নতুন বিনিয়োগ সীমিত করা হয় তবে একটি উল্লেখযোগ্য বিদ্যুৎ সংকট অনিবার্য:
সক্ষমতা হ্রাস: মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০২৯ সালে প্রায় ৩৫,০০০ মেগাওয়াটে পৌঁছালেও, ২০৩৫-৪০ সালের মধ্যে তা কমে প্রায় ৩০,০০০ মেগাওয়াটে নেমে যাবে। এর প্রধান কারণ হলো পুরানো বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হওয়া, গ্যাসের সরবরাহ হ্রাস এবং নতুন প্রকল্প যুক্ত না হওয়া।
চাহিদা বৃদ্ধি: যদি বিদ্যুতের চাহিদা ৬ শতাংশ হারে বাড়ে, তবে ২০৩৩ সালের প্রথম দিকেই চাহিদা সক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যাবে এবং ২০৪০ সালের মধ্যে তা প্রায় ৪০,৯০০ মেগাওয়াটে পৌঁছাবে।
‘অতিরিক্ত সক্ষমতার’ ভ্রান্তি: ‘অতিরিক্ত সক্ষমতা’ ধারণাটি বিভ্রান্তিকর; কারণ ২০৩২ সালের পর কার্যকর উৎপাদন (Effective Generation) পিক চাহিদার (Peak Demand) নিচে নেমে যাবে। ২০৪০ সালের মধ্যে চাহিদা (৩৫,৫৫০ মেগাওয়াট) কার্যকর উৎপাদন (২০,৯০১ মেগাওয়াট) কে ছাড়িয়ে যাবে, ফলে প্রায় ১৪,৬৪৯ মেগাওয়াটের ঘাটতি তৈরি হবে।
বেসরকারি বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টিকারী মূল চ্যালেঞ্জসমূহপ্যানেলিস্টরা এমন কিছু চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছেন যা বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় চাপ সৃষ্টি করছে এবং বেসরকারি মূলধনকে নিরুৎসাহিত করছে। বেসরকারি খাত বর্তমানে দেশের প্রায় ৪৮ শতাংশ ইনস্টলড সক্ষমতা সরবরাহ করে।
বিপিডিবি-এর আর্থিক সংকট: বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি)-এর ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি বকেয়া বিল রয়েছে, যা একটি নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ ক্রেতা হিসেবে এর বিশ্বাসযোগ্যতা দুর্বল করে দিচ্ছে এবং নতুন বিদেশি বিনিয়োগে বাধা দিচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান সার্কুলার ঋণ: বিপিডিবি, আইপিপি এবং গ্যাস সরবরাহকারীদের মধ্যে ৪২ হাজার কোটি টাকার বকেয়া ঋণ খাতের তারল্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
নীতিমালার অস্থিরতা: ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন এবং ৩১টি নবায়নযোগ্য প্রকল্পের বাতিল বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করেছে এবং ক্লিন এনার্জির দিকে ধাবিত হওয়াকে বিলম্বিত করেছে।
সার্বভৌম গ্যারান্টি প্রত্যাহার: সরকার-সমর্থিত গ্যারান্টি প্রত্যাহার করায় বিনিয়োগের ঝুঁকি এবং অর্থায়নের ব্যয় বেড়েছে, যা বিদ্যুৎ বিনিয়োগকে কম লাভজনক করেছে।
বাড়তি ভর্তুকি ও রাজস্ব চাপ: বিদ্যুৎ খাতে ১.৩৯ ট্রিলিয়ন টাকা এবং গ্যাস খাতে ৬৮০ বিলিয়ন টাকা ভর্তুকি বৃদ্ধি সরকারি অর্থায়নে চাপ সৃষ্টি করছে।
জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা: ৬৫০ শতাংশেরও বেশি জ্বালানি আমদানি করা হয়, যা খাতটিকে বিশ্ব বাজারে দামের ওঠানামার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধান চলছে ধীরগতিতে।
নীতি সংস্কার ও ক্লিন এনার্জি সম্প্রসারণের আহ্বানবিদ্যুৎ খাতের ৪৩ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা দ্রুত পরিবর্তিত হতে চলেছে। ২০৩৩-২০৩৫ সালের মধ্যে একটি কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটবে বলে অনুমান করা হচ্ছে, যেখানে দেশীয় গ্যাসের তীব্র হ্রাসের কারণে হেভি ফুয়েল অয়েল (HFO) প্রভাবশালী জ্বালানি (উৎপাদনের ৩৩-৪৫ শতাংশ) হয়ে উঠবে।একটি স্থিতিশীল ও ব্যাংকযোগ্য ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সংলাপ নীতিগত সমন্বয় অপরিহার্য বলে জোর দিয়েছে ।
নীতির প্রভাব: সংকট এড়াতে গ্যাস, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং দক্ষতার upgrade বা উন্নয়ন অপরিহার্য, কারণ শুধুমাত্র ইনস্টলড সক্ষমতার পরিসংখ্যান বাস্তবে প্রস্তুত থাকার মিথ্যা চিত্র দেয়।
ক্লিন এনার্জি বিলম্ব: নীতি পরিবর্তন এবং বিনিয়োগের বিলম্ব ২০৩০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য অর্জনের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে।—বিদ্যুৎ খাতের সংকট মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে আপনি কি আরও তথ্য জানতে চান?