বিশেষ প্রতিবেদক, ঢাকা: পাঁচটি দুর্বল শরীয়া-ভিত্তিক ব্যাংক একীভূত হয়ে গঠিত ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’-র আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হলেও হাজার হাজার ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীর দুর্ভোগ এখনো শেষ হয়নি। চরম নগদ অর্থের সংকট (Cash Fund Crisis) ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে গ্রাস করে রেখেছে, ফলে সাধারণ গ্রাহকরা তাদের অত্যাবশ্যকীয় সঞ্চয় উত্তোলন করতে পারছেন না।
আমানতকারীদের দুর্ভোগের চিত্র খুবই প্রকট। এর জলজ্যান্ত উদাহরণ শোভনম বেগম, সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা তার চিকিৎসা ও দৈনন্দিন খরচ মেটানোর জন্য পেনশন বাবদ পাওয়া অর্থ এক্সিম ব্যাংকের মগবাজার শাখায় রেখেছিলেন। তিনি বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) এই প্রতিবেদককে জানান, গত তিন মাস ধরে নগদ অর্থ সংকটের অজুহাতে ব্যাংক থেকে এক টাকাও তুলতে পারেননি।
শাখা ব্যবস্থাপকের বারংবার ছোট অঙ্কের টাকা দেওয়ার আশ্বাস সত্ত্বেও, বৃহস্পতিবারও তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং আগামী সপ্তাহে আসতে বলা হয়েছে। এভাবে মিথ্যা আশ্বাসে তার পাঁচ মাস কেটে গেছে। তার মতো আরও বহু গ্রাহক তাদের জরুরি প্রয়োজন মেটাতে ন্যূনতম অর্থ উত্তোলন করতে না পেরে অসহায় অবস্থায় রয়েছেন।
গ্রাহকশূন্য শাখাগুলোতে নীরবতা
একীভূত হওয়া এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক—এই পাঁচ ব্যাংকের শাখাগুলো এখন বিরাজ করছে এক নিস্তব্ধ পরিবেশে, যা একসময়কার প্রাণচঞ্চল অবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত। বারবার চেষ্টা করেও টাকা তুলতে ব্যর্থ হওয়ায় অনেক গ্রাহকই এখন আর শাখায় আসা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন।
উদাহরণস্বরূপ, বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের নয়াপল্টন শাখায় গিয়ে দেখা যায় কার্যত কোনো গ্রাহক নেই; হাতেগোনা যে কয়েকজন এসেছেন, তারা কেবল মাসিক ডিপিএস (DPS)-এর টাকা জমা দিতে এসেছেন, যা জনগণের আস্থাহীনতার স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।
সরকারি তহবিল নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য
নতুন ব্যাংকের মূলধন গঠনের জন্য বরাদ্দকৃত ২০ হাজার কোটি টাকা সরকারি তহবিল নিয়ে বিভ্রান্তি কাটছে না। কিছু কর্মকর্তা বাজেট বরাদ্দের কথা বলে তহবিল ছাড়ের দাবি করলেও, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এক শাখা ব্যবস্থাপক ইউএনবিকে নিশ্চিত করেছেন যে এই অর্থ এখনও শাখা পর্যায়ে এসে পৌঁছায়নি। তিনি বলেন, “ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের লিখিত নির্দেশনা ছাড়া আমরা গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছি না।”
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, মূলধন গঠনের জন্য সরকার এখনও কোনো অর্থ ছাড় করেনি। তিনি উল্লেখ করেন, প্রাথমিক সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হলেও দ্রুত অর্থ পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই অনিশ্চয়তা ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’ শক্ত ভিত্তির ওপর কার্যক্রম শুরুর আগেই অংশীদার ব্যাংক ও আমানতকারীদের আস্থা দুর্বল করে দেওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।

১৮ হাজার কর্মীর চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা
একীভূতকরণের সঙ্গে জড়িত এই পাঁচ ব্যাংকে বর্তমানে ১৮,০৮১ জনেরও বেশি কর্মী রয়েছেন, যাদের বেতন-ভাতা বাবদ বছরে প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা খরচ হয়। এই কর্মীরা বেসরকারি ব্যাংকের কর্মী হলেও একীভূতকরণের পর তারা একটি সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকের অংশ হবেন। তবে তাদের চাকরির মর্যাদা, বেতন-কাঠামো এবং সুবিধাদি কী হবে, তা এখনও অনিশ্চিত। জটিলতা আরও বাড়িয়েছে সরকারের এই ব্যাংকটিকে পাঁচ বছরের মধ্যে পুনরায় বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা, যা বিশাল এই কর্মীবাহিনীর দীর্ঘমেয়াদী চাকরি নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
মূলধন কাঠামো ও অগ্রাধিকার
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’-র অনুমোদিত মূলধন হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সরকার ২০ হাজার কোটি টাকা দেবে (অর্ধেক নগদ এবং অর্ধেক সুকুক বন্ডের মাধ্যমে), আর বাকি ১৫ হাজার কোটি টাকা আসবে প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের আমানতকে শেয়ারে রূপান্তরের (Bail-in) মাধ্যমে।
তবে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন যে নতুন ব্যাংক গঠনের পর ক্ষুদ্র আমানতকারীরাই তাদের অর্থ ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবেন। অন্যদিকে, বড় আমানতকারীদের অর্থ পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করা হবে।
নতুন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক শেষে জোর দিয়ে বলেন, আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনাই হবে তাদের প্রধান কাজ। তিনি উল্লেখ করেন যে একটি সরকারি মালিকানাধীন ইসলামী ব্যাংক চালু হওয়া দেশের জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা। ব্যাংকের আইনি একীভূতকরণ সম্পন্ন করা এবং এর ভিশন-মিশন চূড়ান্ত করাই এখন প্রধান অগ্রাধিকার।