নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা :বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বৃহস্পতিবার বলেছেন, দেশের অর্থনৈতিক নীতি স্বাধীনভাবে তৈরি করা হয়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বা বিশ্বব্যাংকের নির্দেশে নয়। তিনি সতর্ক করে বলেন, “যদি আমরা তাদের প্রেসক্রিপশন অন্ধভাবে অনুসরণ করি, তবে পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার মতো মার্কিন ডলারের বিপরীতে বিনিময় হার ১৭০-১৮০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।”
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) বহুমুখী হলে ‘স্থানীয় অংশীদারদের সাথে বিনিয়োগ সংলাপ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেওয়ার সময় গভর্নর এই মন্তব্য করেন। অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাউজুল কবির খান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
মূল্যস্ফীতি ও সুদের হারের পূর্বাভাস
ড. মনসুর আশা প্রকাশ করেন যে চলতি অর্থবছর (২০২৫-২৬)-এর শেষে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে নেমে আসবে। এর ফলে নীতি হার (Policy Rate) কমে ৮-৯ শতাংশে এবং ঋণের হার (Lending Rate) ১০ থেকে ১১ শতাংশের মধ্যে স্থির হতে পারে।
তবে, তিনি ব্যবসায়ীদের কম সুদে ঋণ দেওয়ার দাবির জবাবে সতর্ক করে বলেন যে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ না করে যদি সুদের হার কমানো হয়, তাহলে তা বিনিময় হার এবং মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। এই প্রসঙ্গে তিনি ভারত ও চীনের উদাহরণ দেন, যেখানে তাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ভিন্নতার কারণে সুদের হার যথাক্রমে ৩ শতাংশ এবং শূন্য শতাংশ।
আইএমএফ ঋণ এবং আর্থিক খাতে সংস্কার
আইএমএফের ঋণ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, “আমরা বর্তমানে আইএমএফ ঋণের কিস্তি নিচ্ছি না, কারণ আমাদের অর্থনীতির স্বার্থে কিছু শর্ত এই মুহূর্তে পূরণ করা সম্ভব নয়। যখন প্রয়োজন হবে, তখন আমরা বৈশ্বিক ঋণদাতা সংস্থাটির শর্ত পুরোপুরি পূরণ করে আইএমএফের ঋণ নেব।”
আর্থিক খাত নিয়ে ড. মনসুর বলেন, দেশটি অতীতের তথ্য কারসাজি থেকে বেরিয়ে এসেছে, যা দেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, পূর্ববর্তী সময়ে সরকারী হিসেবে মূল্যস্ফীতি একক অঙ্কে দেখানো হলেও, প্রকৃত মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ১২-১৩ শতাংশ। একইভাবে, খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে একক অঙ্কের নীচে দেখানো হলেও, সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ তা প্রায় ৩৫ শতাংশে ছিল। এসব তথ্য এখন সংশোধন করা হয়েছে।
খেলাপি ঋণ এবং এস আলম গ্রুপের বিদ্যুৎ কেন্দ্র
শিল্প-কারখানার সম্পত্তি বিক্রির মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায়ের বিষয়ে গভর্নর স্পষ্ট করে জানান যে ব্যক্তির অব্যবস্থাপনার জন্য শিল্পকে শাস্তি দেওয়া উচিত নয়।
তিনি এস আলম গ্রুপের এসএস বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদাহরণ দেন, যা এলসি (ঋণপত্র) খোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় এখনও সচল রয়েছে। এই প্রকল্পে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে, যার ৮০ শতাংশই বিদেশি মালিকানাধীন। যদিও প্ল্যান্টটি চলছে, তবে এস আলম গ্রুপ কোনো মুনাফা ধরে রাখতে পারবে না, কারণ সমস্ত অর্থ তাদের দায় পরিশোধে ব্যবহার করা হবে।
ড. মনসুর জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ পুনর্গঠনের জন্য ১,৩০০টি আবেদন পেয়েছে, যার মধ্যে ২৫০টি অনুমোদন করা হয়েছে। বাকি আবেদনগুলো গ্রাহক ও ক্লায়েন্ট-ভিত্তিক পুনর্গঠনের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোতে পাঠানো হয়েছে। তিনি পূর্বাভাস দেন যে ২০২৫–২৬ অর্থবছরের মার্চের মধ্যে খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশ কমবে, তবে সামগ্রিক খেলাপি ঋণকে একটি যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে আনতে ৮–১০ বছর সময় লাগতে পারে।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সংলাপে আন্তর্জাতিক বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী এবং এনবিআর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রহমান খান, এফসিএমএ উপস্থিত ছিলেন।