ঢাকায় প্রতি ২৮ জন নাগরিকের জন্য একটি মাত্র গাছ অবশিষ্ট আছে
নিজস্ব প্রতিবেদক,ঢাকা: অবৈধ জবরদখল ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে বাংলাদেশে বনভূমি উদ্বেগজনক হারে কমছে। সারাদেশে প্রায় ২.৫ লাখ একর বনভূমি অবৈধভাবে দখল হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। এর পাশাপাশি, রাজধানী ঢাকার পরিবেশগত ভারসাম্য চরম ঝুঁকিতে পৌঁছেছে, যেখানে প্রতি ২৮ জন নাগরিকের জন্য একটি মাত্র গাছ অবশিষ্ট আছে।
এই গুরুতর তথ্য গতকাল রোববার (তারিখ এখানে বসবে) ‘কৃষি ও খাদ্যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার’ শীর্ষক চার দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করেন বন বিভাগের উপ-প্রধান বন সংরক্ষক মো. জাহিদুল কবির। বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরাম (বিএজেএফ)-এর আয়োজনে এই অনুষ্ঠানটি ঢাকার তুলা উন্নয়ন বোর্ডের মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাকার সংকটে প্রতি ব্যক্তির জন্য প্রয়োজন ৩টি গাছ:মো. জাহিদুল কবির তার মূল প্রবন্ধে বিশেষভাবে ঢাকার ভয়াবহ পরিস্থিতির ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, একজন মানুষের প্রতিদিন কমপক্ষে ৫৫০ লিটার অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। একটি টেকসই অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে এর জন্য ন্যূনতম তিনটি পূর্ণবয়স্ক গাছ থাকা আবশ্যক।
কবির বলেন, “আমরা এক চরম সংকটের মধ্যে বসবাস করছি। ঢাকাতে বাস্তবতা হলো, প্রতি ২৮ জনের জন্য মাত্র একটি গাছ রয়েছে।”
তিনি আরও জানান, ২০১৫ সালের তুলনায় দেশের বনায়ন প্রায় ১ লাখ একর কমেছে। এর মধ্যে শুধু পাহাড়ি অঞ্চলেই বনায়ন কমেছে ৮৩ হাজার একর।
জীববৈচিত্র্যে প্রধান হুমকি: জবরদখল ও জলবায়ু পরিবর্তন: উপ-প্রধান বন সংরক্ষক জানান, মানুষের কর্মকাণ্ড দেশের জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এর প্রধান কারণগুলির মধ্যে রয়েছে—অবৈধ শিকার ও নির্মাণ, বনভূমি জবরদখল, অগ্নিসংযোগ, এবং ম্যানগ্রোভ ধ্বংস ও নৌ-চলাচলের অনিয়মিত ব্যবহার।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ এসব কারণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বনগুলিকে আরও বেশি করে অরক্ষিত করে তুলছে।
কবির দেশের কার্বন মজুদ সম্পর্কেও তথ্য দেন। তিনি বলেন, দেশের মোট বৃক্ষ আচ্ছাদন (বন ও বনের বাইরে) ৯৭৩ মিলিয়ন টন কার্বন ধরে রেখেছে, যার মধ্যে শুধু বনভূমি এলাকায় রয়েছে ২৫১ মিলিয়ন টন কার্বন। বন সম্প্রসারণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ৪.১৯ লাখ চারা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে কার্বন হ্রাসে সহায়তা করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বনায়নের গুরুত্ব: অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমির হোসাইন চৌধুরী, যিনি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বনায়নের অপরিহার্যতার ওপর জোর দেন।
চৌধুরী বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য বনায়ন হলো সবচেয়ে কার্যকর এবং কম খরচের প্রাকৃতিক সমাধান।”
তিনি উল্লেখ করেন যে বৈশ্বিক ভোগ ও কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবে বাংলাদেশের মতো উচ্চ ঘনত্বের জনবসতিপূর্ণ দেশ (প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১,২০০ জন) বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি রাশিয়ার মতো দেশের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, সেখানে বিশ্বের মোট বনভূমির ২০ শতাংশ থাকা সত্ত্বেও জনসংখ্যা প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মাত্র ৯ জন, যা বাংলাদেশের সীমিত বনজ সম্পদের উপর বিপুল চাপকে নির্দেশ করে।
চৌধুরী আরও জানান, ঢাকার মতো একটি শহরের জন্য ন্যূনতম ২০ শতাংশ সবুজ স্থান সুপারিশ করা হলেও, দুটি সিটি কর্পোরেশনে বর্তমানে সবুজ আচ্ছাদন ১০ শতাংশের সামান্য বেশি।
সুশাসন ও মূল্যবোধ-ভিত্তিক নেতৃত্ব প্রয়োজন: অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন প্ল্যান্টার স্কিল ডেভেলপমেন্টের প্রধান নির্বাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আবুল কালাম আজাদ। তিনি কৃষি ও পরিবেশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
তিনি অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টিকারী বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেন, যার মধ্যে রয়েছে—রাজনৈতিক অসহযোগিতা ও মূল্যবোধের সংকট, সঠিক বিতরণ নীতির অভাব ও নেতৃত্বের শূন্যতা, সিন্ডিকেট গঠন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং মাঠ পর্যায়ে দুর্বল বাস্তবায়ন। তিনি সুশাসন নিশ্চিত করা এবং মূল্যবোধ-চালিত মানুষ গড়ে তোলাকে খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশ সুরক্ষায় কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন।
১৮০ জন সাংবাদিক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞের অংশগ্রহণে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিএজেএফ সভাপতি শাহানুয়ারে শাহিদ শাহিন এবং সাধারণ সম্পাদক আবু খালিও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।