নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা: এক বছর পেরিয়ে গেলেও সরকার ঘোষিত সংশোধিত নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়নে মালিকপক্ষের দীর্ঘসূত্রতায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ট্যানারি শ্রমিকরা। যেকোনো মুহূর্তে কঠোর আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছে ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন। এছাড়া শিল্পে ব্যাপক হারে শ্রমিক ছাঁটাই, অবৈধ কন্ট্রাক্টর ব্যবস্থার বিস্তার এবং চামড়া শিল্পকে বেপজার (বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ) অধীনে নেওয়ার সরকারি উদ্যোগে চরম অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে বলে অভিযোগ করেছে সংগঠনটি।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর দি ডেইলি স্টার সেন্টারের এ এস মাহমুদ সেমিনার হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন এসব তথ্য তুলে ধরে।
এক বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি ন্যূনতম মজুরি
ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক জানান, গত বছরের ২১ নভেম্বর গেজেট অনুযায়ী এবং পরবর্তীতে মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঘোষিত সংশোধিত নিম্নতম মজুরি এখনো পর্যন্ত ট্যানারি শিল্পে বাস্তবায়ন করা হয়নি। প্রায় দুই বছর ধরে আলোচনা, ত্রিপক্ষীয় সভা ও মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সত্ত্বেও মালিকপক্ষ মজুরি বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না।
নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেন, মালিকপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত শ্রমিকদের ‘অস্থায়ী’ তকমা দিয়ে ঘোষিত মজুরি থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করছে, যা সুস্পষ্টভাবে শ্রম আইনের লঙ্ঘন। একই সঙ্গে মজুরি বোর্ডের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পর মালিকদের সঙ্গে পূর্বের মতো দ্বি-পক্ষীয় চুক্তি নবায়নের কথা থাকলেও তা বিলম্বিত হচ্ছে, ফলে শ্রমিকদের অন্যান্য প্রাপ্ত সুবিধাও অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
ছাঁটাই, কন্ট্রাক্টর ব্যবস্থা ও বেপজা উদ্বেগ
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ট্যানারি শিল্পকে বেপজার অধীনে নেওয়ার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে ইউনিয়নকে অবহিত না করাটা অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ।
ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, পরিকল্পিতভাবে দক্ষ ও অভিজ্ঞ শ্রমিক এবং মেশিনম্যানদের ছাঁটাই করে তাদের জায়গায় কন্ট্রাক্টরের লোক দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকরা তাদের আইনানুগ পাওনাও পাচ্ছেন না। তারা মন্তব্য করেন, এর মাধ্যমে একটি আনুষ্ঠানিক (formal) খাতকে ইচ্ছাকৃতভাবে অনানুষ্ঠানিক (informal) শ্রম ব্যবস্থায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য: সংগঠনের স্বাধীনতা ঝুঁকিতে
শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্য অ্যাডভোকেট এ. কে. এম. নাসিম বলেন, “গেজেট প্রকাশিত হওয়ার পরও মজুরি বাস্তবায়নে মালিকপক্ষের গড়িমসি এবং সরকারি দপ্তরগুলোর নিষ্ক্রিয়তা উদ্বেগজনক। আইন অনুযায়ী স্থায়ী, অস্থায়ী বা ঠিকাদারি সব শ্রমিকই সমান মজুরির অধিকারী, কিন্তু মজুরি বাস্তবায়নে সর্বত্র অনীহা দেখা যাচ্ছে।”
ট্যানারি শিল্পকে ইপিজেডের অধীনে স্থানান্তর করার উদ্যোগের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “ট্যানারি সেক্টরকে ইপিজেডের অধীনে স্থানান্তর করা হলে শ্রমিকদের সংগঠনের স্বাধীনতা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, সদ্য সংশোধিত শ্রম আইনে প্রতিষ্ঠানপুঞ্জ কাঠামোর আওতায় মাত্র ২০ জন শ্রমিক মিলে ইউনিয়ন গঠন করা যাবে, তবে সংখ্যা সর্বোচ্চ পাঁচটিতে সীমাবদ্ধ থাকবে, যা শ্রমিকদের সংগঠনগত শক্তিকে আরও দুর্বল করে তুলবে।
শ্রম সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, “ট্যানারি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হলেও এতে এখনও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় রয়েছে। শ্রমিকদের দীর্ঘদিন অস্থায়ী রাখা, ঘোষিত নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়নে বিলম্ব এবং পর্যালোচনার নামে পুনরায় অনিশ্চয়তা সৃষ্টি আস্থার ভিত্তিকে দুর্বল করছে, যার প্রভাব শেষ পর্যন্ত পুরো শিল্প ও জাতীয় অর্থনীতিতেই পড়বে।” তিনি শিল্পে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে শ্রমিকদের জন্য সম্মানজনক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র ও মালিকপক্ষের প্রতি যৌথ দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান।