অর্থনৈতিক প্রতিবেদক, ঢাকা:
দেশের ব্যাংকিং খাতে ধীরে ধীরে গ্রাহকের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০২৫) এর স্পষ্ট ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে। এ সময়ে ব্যাংকগুলোর বাইরে মানুষের হাতে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ কমেছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা, যা সরাসরি ব্যাংকগুলোতে আমানত হিসেবে ফিরে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে মোট আমানত বেড়েছে প্রায় ৩৪ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরের শেষে ১৯ লাখ ১৪ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
আস্থা ফেরায় প্রধান কারণ
অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকিং কর্মকর্তারা বলছেন, বেশ কয়েকটি কারণে এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে:
- আস্থা পুনরুদ্ধার: বিগত সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অনিয়ম ও লুটপাটের কারণে গ্রাহকদের মধ্যে যে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদহার বৃদ্ধি ও সংস্কারমূলক পদক্ষেপের ফলে তা কাটতে শুরু করেছে।
- নির্বাচনী অনিশ্চয়তা দূর: সাধারণ নির্বাচনের পরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর হওয়ায় অনেকেই বিনিয়োগের ঝুঁকি না নিয়ে ব্যাংকে টাকা রাখাকে নিরাপদ মনে করছেন।
- সুদহার বৃদ্ধি: ব্যাংকগুলো এখন স্থায়ী আমানতের বিপরীতে ৯ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে, যা মানুষকে আবার সঞ্চয়ে আগ্রহী করে তুলেছে। সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাংক খাতে আমানতের গড় সুদের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৪২ শতাংশ।
- মূল্যস্ফীতিতে নিম্নমুখী প্রবণতা: উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমায় (সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৮.৩৬%) মানুষের খরচ কমছে এবং সঞ্চয় সক্ষমতা বাড়ছে।
নগদ অর্থ কমেছে ২২ হাজার কোটি টাকা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ‘কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক’ বা ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থ কমেছে প্রায় ২১ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। এর অর্থ হলো এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যাংক ব্যবস্থায় ফিরে এসেছে। গত জুন শেষে যা ছিল ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা, তা সেপ্টেম্বর শেষে ২ লাখ ৮৭ হাজার ২৯৪ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিভাগের একজন কর্মকর্তা এই প্রবণতাকে আশাব্যঞ্জক বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি জানান, এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে গ্রাহকের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে, অর্থনীতির চাপ কমছে এবং নীতিগত পদক্ষেপগুলো ফল দিতে শুরু করেছে।
বিনিয়োগে গতিহীনতা
তবে আমানত বৃদ্ধি পেলেও বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের গতি ফেরেনি, যা সামগ্রিক বিনিয়োগে মন্থরতা বজায় রেখেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই মাসে বেসরকারি খাতের ঋণে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০.১৩ শতাংশ। সেটি কমতে কমতে গত সেপ্টেম্বরে ৪ বছরের সর্বনিম্ন, ৬.২৯ শতাংশে নেমে এসেছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব বাড়ার কারণে মানুষের সঞ্চয়ের সক্ষমতা কমেছে। তাই আমানত বাড়লেও তা ঋণের চাহিদা বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা উদ্যোগেই আস্থা ফিরছে, তবে সুদের হার বাড়লেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির তুলনায় তা এখনও খুব বেশি নয়।