নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বহুতল ভবন, ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি এবং সরু রাস্তার কারণে ঢাকায় ভূমিকম্পে ক্ষয়-ক্ষতির সম্ভাব্য ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বাড়ছে। অনেক ভবনই ভূমিকম্প সুরক্ষা মানদণ্ড মেনে তৈরি হয়নি, যা এগুলোকে মৃত্যুফাঁদে পরিণত করেছে।
এছাড়াও বাংলাদেশের মাটির গঠনগত দুর্বলতাও এই ঝুঁকির একটি বড় কারণ। দেশের বেশিরভাগ এলাকা আলগা ও জলাবদ্ধ পলিমাটির ওপর গঠিত। শক্তিশালী কম্পনে এই মাটি তরলীকৃত (liquefaction) হয়ে যেতে পারে, যা বড় ধরনের ভবন ধসের কারণ হতে পারে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অধীনে থাকা ভবনগুলোর উপর করা এক জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ ভবনই ২০ থেকে ৩০ বছর আগে নির্মিত। অনেক স্থানে রড-সিমেন্টের মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি, আবার কোথাও অনুমোদিত নকশার বাইরে গিয়ে ভবন তৈরি করা হয়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, সামান্য কম্পনেও এসব ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শুক্রবারের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ১৪ ভবন
গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) আঘাত হানা ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে রাজধানীর ১৪টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসার মো. সালাহ উদ্দীন-আল-ওয়াদুদ। তার দেওয়া তথ্যমতে, মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় ১টি, আরমানিটোলায় ১টি, সূত্রাপুরের স্বামীবাগে ১টি, বনানীতে ১টি, কলাবাগানে ১টি, বসুন্ধরায় ১টি, নর্দ্দা এলাকায় ১টি, দক্ষিণ বনশ্রীতে ১টি, মোহাম্মদপুরে ১টি, খিলগাঁও এলাকায় ২টি, বাড্ডা এলাকায় ১টি, মগবাজারের মধুবাগে ১টি এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় ১টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা এবং ঝুঁকিপূর্ণ মহানগরী
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, রাজধানীতে গড়ে ওঠা ভবনগুলো ভূমিকম্প সহনীয় কি না, তা নির্ণয়ের মতো প্রয়োজনীয় জনবল ও যন্ত্রপাতি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছে নেই। ঢাকায় অনুমোদনহীন ভবনের সঠিক সংখ্যাও তাদের জানা নেই। খাল-বিল নদী দখল করে কত ভবন হয়েছে, সেই সংখ্যাও অজ্ঞাত।
তারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ঢাকায় লাখ লাখ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ভবন অপসারণ না করেই নতুন নির্মাণ কাজ চলছে। ফলে ঢাকায় বসবাস করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পরিকল্পনামাফিক ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) বাস্তবায়ন করা দরকার। তা না হলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে দেশে ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তাই সব নতুন ভবন নির্মাণে নকশা ও বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে অনুসরণ করা আবশ্যক।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, শুক্রবারের ভূমিকম্পটি বড় ভূমিকম্প আসার আগে হওয়া ছোট ছোট কম্পনগুলোর মধ্যে অন্যতম। রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রায় যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেড়ে যাবে, ভেঙে যাবে বহু ভবন, প্রচুর হতাহত হবে। ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে এমন ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে।
নীতিগত দুর্বলতা ও প্রতিকারের পথ
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, এই ভূমিকম্প বার্তা দিচ্ছে যে আমাদের এখানে বড় আকারে ভূমিকম্প আসছে। শুক্রবারের বড় ঝাঁকুনির পর এখন ঢাকা শহরের প্রতিটি অধিবাসী অনুভব করতে পারছে বিপদ নিকটে।
তিনি জানান, ভূমিকম্পের মতো বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় ঢাকা শহরে জনসাধারণের আশ্রয় নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ ও খোলা জায়গার মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে।
ড. খান আরও বলেন, বাংলাদেশে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি, ২০২০), ঢাকা মহানগরীর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮, ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) সহ একাধিক পরিকল্পনাগত নীতি ও বিধান বিদ্যমান। কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তদারকি দুর্বলতা, রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি ও জবাবদিহির অভাব পরিস্থিতিকে অকার্যকর করে তুলেছে।
করণীয় নিয়ে এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। জরুরি ভিত্তিতে কঠোরভাবে ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড ও নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করতে হবে। বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি (বিবিআরএ) গঠন করে দ্রুত বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর তালিকা প্রকাশ ও উচ্ছেদের পদক্ষেপ নিতে হবে।
নকশাবিহীন ভবনে বৈধতা দিতে খসড়া নীতিমালা
রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে বিধিবহির্ভূত ৩ হাজার ৩৮২টি ভবন চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শুক্রবারের ভূমিকম্পের পর এলাকাভিত্তিক কর্মকর্তাদের মাঠে নামানো হয়েছে এবং যেসব ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে, তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, রাজউকের আওতাধীন এলাকায় গড়ে ওঠা লাখ লাখ নকশাবিহীন অবৈধ ভবনের বিষয়ে একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে সংস্থাটি। সেই নীতিমালায় প্রস্তাব করা হয়েছে, যেসব ভবন ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে, রাজউকের মাস্টার প্ল্যানের ব্যত্যয় না ঘটিয়ে এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করে গড়ে উঠেছে, সেগুলোকে বৈধতা দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান নকশা অনুমোদন ফি’র তিন থেকে পাঁচ গুণ জরিমানা আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।
ড্যাপ সংশোধনের প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন
রাজধানীকে পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য মহানগরী গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রণীত রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধনের প্রস্তাব নীতিগতভাবে সরকার অনুমোদন দিয়েছে। সংশোধিত ড্যাপে ঢাকাকে আগের ২৭৫টি ব্লকের পরিবর্তে ৬৮টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এতে ভবনের উচ্চতা বাড়ার পাশাপাশি সর্বোচ্চ জনঘনত্ব ২৫০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ করা হয়েছে।

সংশোধিত ড্যাপ ও খসড়া ‘ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা-২০২৫’ অনুযায়ী, বহু এলাকায় ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আগে যেখানে সর্বোচ্চ পাঁচতলা ভবন নির্মাণের অনুমতি মিলত, সেখানে এখন ১০ থেকে ১১ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণ করা যাবে। নতুন বিধিমালায় একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত যোগ করা হয়েছে: প্লটে যত বেশি খোলা জায়গা রাখা হবে, ভবনের উচ্চতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সেই অনুপাতে অতিরিক্ত ছাড় দেওয়া হবে।
ঢাকার কাছাকাছি ভূমিকম্পের ইতিহাস
এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ঢাকার কাছে ফরিদপুরে গত ১৫ বছরে দুইবার ৪-এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। গত ১৫-২০ বছরের মধ্যে ঢাকার কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প ছিল ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জে হওয়া ৫.১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প। এছাড়া ১৮২২ ও ১৯১৮ সালে ঢাকার অদূরে মধুপুর ফল্টে এবং ১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে ৭.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের ইতিহাস রয়েছে। সর্বশেষ শুক্রবার আঘাত হানা ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার কাছের নরসিংদীর মাধবদী।