ঢাকা : দেশের ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, আর্থিক স্থিতিশীলতা জোরদার এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিবেদন স্ট্যান্ডার্ড (আইএফআরসি ৯) এর সঠিক ও যথাযথ বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)।
আজ মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) আইসিএবি আয়োজিত “Implementing IFRS 9: Global Insights and Bangladesh Perspectives” শীর্ষক এক ওয়েবিনারে বক্তারা এই গুরুত্বের ওপর জোর দেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আইএফআরএস ৯-এর কার্যকর প্রয়োগের জন্য শক্তিশালী মডেলিং, নির্ভরযোগ্য ডেটা এবং ঝুঁকি ও অর্থায়ন (Risk and Finance) ফাংশনগুলোর মধ্যে সমন্বিত সহযোগিতা একান্ত অপরিহার্য।
বাংলাদেশের জন্য আইএফআরএস ৯ একটি ‘প্যারাডাইম শিফট’
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. মো. কবির আহমেদ, যিনি দেশের আর্থিক খাতের জন্য আইএফআরএস ৯-এর গুরুত্ব তুলে ধরেন।
ড. আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশের মতো একটি উদীয়মান অর্থনীতির জন্য—যার আর্থিক খাত গতিশীল ও সম্প্রসারণশীল—আইএফআরএস ৯ এর বাস্তবায়ন একটি প্যারাডাইম শিফট ।” তিনি যোগ করেন, এই স্ট্যান্ডার্ড আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ক্ষতির জন্য আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করতে এবং অর্থনৈতিক ধাক্কা মোকাবিলায় আরও সহনশীল করে তুলবে।
আইসিএবি-এর প্রেসিডেন্ট এন কে এ মবিন এফসিএ বলেন, আইএফআরএস গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কেবল একটি “কারিগরি কমপ্লায়েন্স অনুশীলন” নয়, বরং এটি স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, আর্থিক দৃঢ়তা এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনের মূল ভিত্তি।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, আইএফআরএস ৯ এর কার্যকর বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি)-সহ সংশ্লিষ্ট প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো প্রস্তুতকারকদের যৌথ প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
বাস্তবায়নের প্রধান চ্যালেঞ্জ: ডেটার অভাব ও দুর্বল মডেলিং
ওয়েবিনারে বিশেষজ্ঞরা আইএফআরএস ৯ বাস্তবায়নে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেন:
প্রমাণভিত্তিক ডেটার অপ্রতুলতা: বিশেষজ্ঞরা জানান, ঋণের খেলাপি হওয়ার ডেটা সহজে পাওয়া গেলেও, ঋণ পুনরুদ্ধারের (recovery) ডেটা এখনও পর্যাপ্ত নয়। এই ডেটার অভাব মডেলের পূর্বাভাস ক্ষমতাকে সীমিত করে এবং বাস্তবায়নের গতি কমিয়ে দেয়।
ভবিষ্যৎমুখী তথ্যের অভাব: অনেক ব্যাংকের কাছেই ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আলাদা করার বা নির্ভরযোগ্য সম্ভাব্যতা-ভারিত অনুমান করার জন্য পর্যাপ্ত ঐতিহাসিক ডেটা নেই।
শ্রীলঙ্কার ইনস্টিটিউট অফ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস-এর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট লিডার এবং আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়াং-এর পার্টনার রাজিত পেরেরা মূল প্রবন্ধে বলেন, অনেক ব্যাংকেরই প্রত্যাশিত ক্রেডিট লস (ECL) অনুমান করার জন্য শক্তিশালী মডেলের অভাব রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, যাচাই-বাছাইয়ে দেখা গেছে, বিদ্যমান মডেলগুলো ‘Probability of Default (PD)’ এবং ‘Loss Given Default (LGD)’ এর সঠিক অনুমান তৈরির জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।
অন্যান্য বক্তা আশিক ইকবাল এফসিএ, পার্টনার, নুরুল ফারুক হাসান অ্যান্ড কোং, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস, বলেন যে পুরোনো ‘ইনকার্ড লস মডেল’ থেকে ‘এক্সপেক্টেড ক্রেডিট লস (ECL)’ কাঠামোতে আসা অনেক ব্যাংকের জন্য কেবল কমপ্লায়েন্স ইস্যু নয়, বরং এটি একটি”বেঁচে থাকার পরীক্ষা”।
তিনি সতর্ক করে বলেন, দুর্বল মডেল, অসামঞ্জস্যপূর্ণ খেলাপি সংজ্ঞা বা ত্রুটিপূর্ণভাবে ডিজাইন করা সিনারিওগুলো স্বচ্ছতা না এনে বরং বিভ্রান্তি বাড়াতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য বিশেষজ্ঞরা একটি বহুমাত্রিক পদ্ধতির সুপারিশ করেন। এর মধ্যে রয়েছে:
* স্বয়ংক্রিয়তা, ডেটা ইন্টিগ্রেশন এবং রিয়েল-টাইম রিপোর্টিংকে সমর্থন করার জন্য শক্তিশালী প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ ।
* শক্তিশালী গভর্নেন্স কাঠামো এবং তদারকি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
* ঝুঁকি প্রোফাইল এবং নিয়ন্ত্রক প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে আরও ভালোভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার জন্য পোর্টফোলিও সেগমেন্টেশন কৌশলগুলো পুনর্বিবেচনা করা।
* বর্ধিত ডেটার সূক্ষ্মতা এবং ঘন ঘন রিপোর্টিং পরিচালনার জন্য ডেটা অবকাঠামোকে শক্তিশালী করা ।
ওয়েবিনারে সভাপতিত্ব করেন আইসিএবি-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং রহমান রহমান হক, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস-এর পার্টনার মুহাম্মদ মেহেদী হাসান ।