ঢাকা, ২১ জুন : অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ বা আমলা কেউই প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতি বন্ধ করতে চান না।
রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি (বিইএ) আয়োজিত বাজেট নীতি বিতর্ক সংক্রান্ত এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শনিবার (জুন ২১) তিনি এ কথা বলেন।
বিইএ-এর আহ্বায়ক মাহবুব উল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা জাতীয় বাজেট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান সম্পদের ব্যাপক অপচয়ের কথাও তুলে ধরেন এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অঙ্গীকারের ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, অপচয়, দুর্নীতি ও অদক্ষতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। ফাওজুল কবির বেশ কিছু জঘন্য উদাহরণ তুলে ধরেন, যার মধ্যে রয়েছে শুধুমাত্র একজন মন্ত্রীর সুবিধার জন্য পানির উৎস থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, অপ্রয়োজনীয় সড়ক নির্মাণ এবং রাষ্ট্রীয় তহবিলের অব্যবস্থাপনা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ম্যান্ডেট প্রসঙ্গে ফাওজুল কবির জোর দিয়ে বলেন, তাদের লক্ষ্য ভবিষ্যতের জন্য একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। তিনি বলেন, “আমরা এমন একটি উদাহরণ রেখে যেতে চাই যেখানে আমরা আত্মীয়স্বজনকে নিয়োগ করব না বা ব্যবসায়িক সুবিধা দেব না,” সুশাসনের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের ওপর জোর দেন তিনি।
বিদ্যুৎ খাত নিয়ে ফাওজুল কবির উল্লেখ করেন যে, অভ্যন্তরীণ গ্যাসের মজুদ কমে যাওয়ায় আমদানিকৃত এলএনজি-র ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, যার জন্য সরকারকে বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য, সকল সরকারি ভবনে সৌর প্যানেল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি আরও জানান, ছাদে সৌর প্যানেল বসিয়ে বেসরকারি খাত থেকেও অন্তত ২,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ্ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত বাজেট আপাতদৃষ্টিতে গতানুগতিক মনে হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা নির্ধারণ করতে পারে বাজেটের আয়প্রবাহ কোন উৎস হতে আসবে আর কোন জনগোষ্ঠীর জন্য কোন কোন খাতে অর্থ ব্যয় হবে।
আলোচনাপর্যায়ে ঘোষিত বাজেটের ৯টি দিক নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ, পেশাজীবী ও নীতিনির্ধারকগণ। বাজেট প্রবন্ধে ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ জহির ঘোষিত বাজেটের স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি টেকসই উন্নয়নের দিকটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বাজেট ঘাটতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সংখ্যার হিসেবে আরো স্বচ্ছতা থাকা উচিত বলে মনে করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা পরিচালক মোঃ গুলজার নবী বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান জিডিপির আয়তন ৪৬৭ বিলিয়ন উল্লেখ করে সামষ্টিক অর্থনীতির মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এক্ষেত্রে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং তৈরি পোশাক খাতের অবদানকে তুলে ধরেন।
বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সিটিউটের অধ্যাপক শাফিউন নাহিন শিমূল প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের উদাহরণ টেনে স্বাস্থ্য বাজেটকে খাতওয়ারী খরচ হিসেবে চিন্তা না করে মানবসম্পদ উন্নয়নের একটি স্মার্ট বিনিয়োগ হিসেবে গুরুত্ব আরোপ করেন এবং এক্ষেত্রে ঘোষিত বাজেটের স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ জিডিপির ১.৭ শতাংশকে অপ্রতুল মনে করেন।
বাজেটে শিক্ষাখাতের বরাদ্দ নিয়ে বিশ্লেষণ করে বিআইডিএস-এর গবেষণা পরিচালক জুলফিকার আলি শিক্ষা ও কর্মখাতের যে অসামঞ্জস্য বিরাজমান তা দূরীকরণে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষায় আরো বরাদ্দ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন। তিনি ভারত, নেপাল ও মালয়েশিয়ার উদাহরণ উল্লেখ করে বলেন, আমাদের বাজেটে শিক্ষাখাতের বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে শিক্ষক ও শিক্ষা উপকরনের ক্ষেত্রে আরো বরাদ্দ বৃদ্ধি উচিত বলে মনে করেন। তাছাড়া বর্তমান সরকারের উদ্যোগে শিক্ষা কমিশন না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেন।
বাজেটে সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন এবং আয় অসমতা দূরীকরণের ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বরাদ্দকে অপ্রতুল উল্লেখ করেন বিআইজিডির গবেষণা পরিচালক মুন্সী সুলায়মান। তিনি নতুন প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে উৎপাদনশীল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করার প্রস্তাব দেন। নারীর নিরাপত্তা, কর্মক্ষেত্র ও সরকারি সেবায় নারীদের প্রবেশাধিকার এবং নারীখাতে বাজেট হ্রাস পেয়েছে বলে উল্লেখ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শারমিন্দ নীলোর্মি ।
এক্ষেত্রে একটা টোকেন বরাদ্দ এ বাজেটে থাকা উচিত ছিল বলে তিনি মনে করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের উপ-উপাচার্য ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, বাজেটের কয়েকটি খাতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। তাছাড়া বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বেসরকারি খাতে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভবিষ্যৎ সমস্যা তৈরি করবে। বিআইডিএস-এর শিল্প বিভাগের গবেষণা পরিচালক কাজী ইকবাল ডিগ্লোবালাইজেশন ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলোর অভ্যন্তরীণ শিল্পায়নের প্রবণতা উল্লেখ করে বাংলাদেশের জাতীয় শিল্পনীতিতে এর প্রতিফলন না হওয়ার সমালোচনা করেন। রপ্তানিমুখী শিল্পে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ব্যতিত ট্যারিফ হ্রাস ফলপ্রসূ হতে পারে না বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। জাতীয় বাজেটকে রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল হিসেবে অভিহিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর জনগণের অর্থের ওপর জনগণের মালিকানা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন এবং বাজেট নিয়ে সংসদীয় কমিটির আলোচনা ও মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
প্যানেল আলোচনা পর্বে বিআইডিএস এর মহাপরিচালক অধ্যাপক এ কে এনামুল হক গতানুগতিকতা বিবর্জিত সুচিন্তিত বাজেট নীতির মাধ্যমে বিনিয়োগের সাথে উদ্ভাবনের সমন্বয়ের উপর জোর আরোপ করেন।
আইসিবি এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, যথাযথ সংস্কার ছাড়া ট্যাক্সের অনুপাত বৃদ্ধি পেলে তা শুধুমাত্র দুর্নীতি ও অদক্ষতার অর্থায়নে পরিণত হবে। অর্থবাজারের সীমানা পেরিয়ে পুঁজিবাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা সুদিন ফিরিয়ে আনতে পারে বলেও তিনি মনে করেন।
বাজেটের রাজনৈতিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে ন্যাশনাল ব্যাংক পিএলসি এর চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কর্তৃক সাংবিধানিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দখল ও লুণ্ঠনের অপসংস্কৃতির প্রতি আলোকপাত করেন। সংকুচিত মুদ্রানীতির প্রভাব সামাল দিতে বিনিয়োগের পূর্বশর্তগুলো পূরণ না হলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি সম্ভব নয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য মোহাঃ ফরিদ উদ্দীন খান সরকারি তথ্যের অপ্রতুলতা ও জনসাধারণের সামগ্রিক নিরাপত্তার অভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। দেশের প্রতি ভালবাসা ও দায়বদ্ধতা ছাড়া কোনো বাজেটই বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলেও তিনি অভিমত দেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অরাজনৈতিক হওয়ায় বাজেটের রাজনৈতিক আলোচনা কিছুটা নিরর্থক, তবে এই বাজেট ও এর বাস্তবায়ন গবেষণার বিষয় হতে পারে যা সময়ের দলিল