ঢাকা, ২১ আগস্ট : বাংলাদেশের জন্য কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং।
ভৌগোলিক নৈকট্য, বাণিজ্যিক সংযোগ, এবং স্বাস্থ্য খাতে ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার কারণে এই শহরটি বর্তমানে ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।‘সিটি অব ইটার্নাল স্প্রিং’ নামে পরিচিত কুনমিং, যা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের একটি মূল গেটওয়ে হিসেবে ভূমিকা পালন করে, এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সংযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবার নতুন গন্তব্য কুনমিংঢাকা থেকে মাত্র সোয়া ২ ঘণ্টার বিমান যাত্রার দূরত্বে অবস্থিত কুনমিং, বাংলাদেশের রোগীদের জন্য একটি নতুন চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে। বিশেষ করে ক্যান্সার, হৃদরোগ ও নিউরোসংক্রান্ত জটিল রোগের উন্নত চিকিৎসার জন্য কুনমিংয়ের আধুনিক হাসপাতালগুলো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন রোবোটিক সার্জারি ও বিশেষায়িত সেবা প্রদান করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে, চীনা কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশী রোগীদের জন্য ‘গ্রিন চ্যানেল’ ভিসা সুবিধা চালু করেছে, যা দুই দেশের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ককে আরো দৃঢ় করছে।
বাংলাদেশ-কুনমিং সম্পর্ক: একটি বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ:কুনমিং কেবল স্বাস্থ্যসেবায় নয়, বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবিরের মতে, কুনমিং ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের চীনা শহর, যা যাতায়াত ও পারস্পরিক সংযোগের ক্ষেত্রে বড় সুবিধা দেয়। তিনি বলেন, “বিসিআইএম ইকোনমিক করিডোর ধারণার সূচনালগ্ন থেকেই কুনমিং বাংলাদেশের জন্য একটি কেন্দ্রবিন্দু ছিল।”প্রতি বছর কুনমিংয়ে অনুষ্ঠিত চায়না-দক্ষিণ এশিয়া এক্সপো বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য চীনের বাজারে প্রবেশের একটি বড় সুযোগ তৈরি করে।
২০২৫ সালের এক্সপোতে বাংলাদেশসহ অংশগ্রহণকারী দেশগুলো কয়েকশ কোটি ইউয়ানের বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা অর্থনৈতিক সম্পর্কের গভীরতা প্রমাণ করে।
কূটনৈতিক এবং যোগাযোগ বৃদ্ধি:চলতি বছরের ১৯ জুন কুনমিংয়ে চীন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম ত্রিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যা আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।এছাড়াও, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় ইউনান প্রদেশকে বাংলাদেশের সমুদ্র ও স্থলবন্দরের সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
চীনের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে ঢাকা-কুনমিং রুটে ফ্লাইট চালুর অনুমতি দিয়েছে, যা দুই দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে আরো সহজ করবে।
জনগণের মধ্যে সম্পর্ক এবং ভবিষ্যত সম্ভাবনা:ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর চায়না স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ড. সামসাদ মর্তুজা মনে করেন, কুনমিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি পূর্ণাঙ্গ ইকোসিস্টেম গড়ে উঠছে, যেখানে শুধু চিকিৎসা নয়, বরং আবাসন, খাদ্য এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সুযোগও তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, “যখন প্রকৃত সেবা পাওয়া যায় তখন এর প্রভাব অন্য মাত্রার হয়ে ওঠে।
পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশেও চীনের হাসপাতাল গড়ে উঠতে পারে, যা দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুবই ইতিবাচক।”সব মিলিয়ে, কুনমিং তার ভৌগোলিক নৈকট্য, অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য ও মানবিক সহযোগিতার কারণে বাংলাদেশের জন্য একটি বহুমাত্রিক কৌশলগত বিন্দুতে পরিণত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতের পারস্পরিক সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করবে।