নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা : দেশের সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা (IEPMP) দ্রুত সংশোধন করে তাতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের অংশীদারত্ব উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য নবায়নযোগ্য খাতে বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণের ওপর জোর দেন তাঁরা।1
শনিবার (৬ ডিসেম্বর) রাজধানীর বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘরে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী **’তৃতীয় বাংলাদেশ জ্বালানি সম্মেলন’-**এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা এই আহ্বান জানান।2 বাংলাদেশের প্রতিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক কর্মজোট (BWGED)-সহ ১৬টি সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।
মূল বক্তব্য এবং পরামর্শ
বিশেষজ্ঞরা বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর মহাপরিকল্পনা নবায়নযোগ্য জ্বালানির স্বার্থ রক্ষা করছে না।3 দেশীয় সক্ষমতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে নীতি বাস্তবায়নের পরামর্শ দেওয়া হয়:
- নীতিমালা ও বাস্তবায়ন: পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “জ্বালানি রূপান্তর একটি সময়সাপেক্ষ কাজ। বড় লক্ষ্য ঘোষণা করে অর্জন না হওয়া থেকে বরং বাস্তবভিত্তিক নীতিমালা প্রণয়নই বেশি জরুরি।” তিনি সরকারি ভবনের ছাদে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের উদ্যোগ দ্রুত এগিয়ে চলার কথা উল্লেখ করেন।
- নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি: উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন BWGED-এর আহ্বায়ক অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম, যিনি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিতে জ্বালানি রূপান্তরকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানান।4
- সক্ষমতা বৃদ্ধি: সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, কার্যকর জ্বালানি রূপান্তরের জন্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান, সঠিক নীতি এবং দক্ষ জনবল—এই তিনটির সমন্বয় অপরিহার্য। তিনি বিদেশি পরামর্শক নির্ভরতা কমিয়ে নীতি বাস্তবায়নে দেশীয় সক্ষমতা গড়ে তোলার তাগিদ দেন।5
- নীতিগত বাধা: সেন্টার ফর রিনিউয়েবল এনার্জি সার্ভিসেস লিমিটেডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী নীতিগত প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরে বলেন, “প্রতি বছর বিদ্যুৎ খাতে ৪ বিলিয়ন ডলার সাবসিডি দেওয়া হয়। এর অর্ধেক নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ করা হলে খাতের চিত্র পাল্টে যেত।6 কিন্তু নীতিমালা নবায়নযোগ্যবান্ধব নয় বলেই অগ্রগতি ধীর।” তিনি IEPMP-তে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে প্রাধান্য দেওয়ার আহ্বান জানান।
- স্বচ্ছতা ও জনঅংশগ্রহণ: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মন্তব্য করেন, অতীতে জ্বালানি খাতে ‘নীতিগত অপরাধ’ ঘটেছে এবং বিদেশি পরামর্শকদের মহাপরিকল্পনা কখনোই নবায়নযোগ্য শক্তিকে অগ্রাধিকার দেয় না।7 লিড বাংলাদেশের গবেষণা পরিচালক অ্যাডভোকেট শিমনুজ্জামান জ্বালানি রূপান্তরে আইনগত স্বচ্ছতা এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন।
- ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর: মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের বনশ্রী মিত্র নিয়োগী ন্যায়সঙ্গত জ্বালানি রূপান্তরের কেন্দ্রে প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠ স্থাপন এবং নারীদের জন্য আলাদা বরাদ্দ নিশ্চিতের কথা বলেন।
অগ্রগতি ও উদ্বেগ
বিশেষজ্ঞ বক্তারা গত এক বছরে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতির কথা উল্লেখ করেন:
- নতুন কোনো জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন না দেওয়া।
- নবায়নযোগ্য খাতে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া।
- ৫,২৩৮ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুতের দরপত্র আহ্বান এবং ৩,০০০ মেগাওয়াট ছাদভিত্তিক সৌর প্রকল্পের উদ্যোগ।
তবে, উদ্বেগও প্রকাশ করা হয়:
- ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২,২২০ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর অনুমোদন, যা অলস সম্পদের বোঝা আরও বাড়াচ্ছে।
- সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ৩২,৫০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে।
- এলএনজি আমদানি ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় ৪০,৭৫৯ কোটি টাকার বিশাল ব্যয় অর্থনীতির জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই সম্মেলন জ্বালানি নীতি, নবায়নযোগ্য বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং জলবায়ু ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অগ্রগতি ও সংলাপের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে।