বুধবার ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫
সর্বশেষ:
বিএপিএলসির সভাপতি রিয়াদ মাহমুদ, সহ-সভাপতি ইশতিয়াক আহমেদ ঢাবিতে চার দিনব্যাপী বিআইআইটি-আইআইআইটি উইন্টার স্কুল শুরু চলতি বছরে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত জনশক্তি রপ্তানি ১০ লক্ষাধিক খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ জহুরুল ইসলামের ইন্তেকাল: বিআইআইটি-এর শোক নতুন পাঠ্যবই মুদ্রণ ও বিতরণে বিঘ্নের আশঙ্কা নেই: সালেহউদ্দিন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক শ্রম সংস্কার, বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ ফরেন এক্সচেঞ্জ বাজার স্থিতিশীল রাখতে ১৩ ব্যাংক থেকে ২০২ মিলিয়ন ডলার কিনলো বাংলাদেশ ব্যাংক বিজিএমইএ এর স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ সম্প্রসারণ: আরও ৪টি হাসপাতালের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর মিরসরাইয়ের বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনা কোম্পানির ১০.৩২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ

কৌশলগত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বে আগ্রহী থাইল্যান্ড: দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ‘ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্য’ থেকে উত্তরণের লক্ষ্য

শীঘ্রই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) চূড়ান্ত করার উপর জোর; বঙ্গোপসাগরকে সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক করিডোরে পরিণত করার যৌথ প্রচেষ্টা

ঢাকা, ৫ ডিসেম্বর: বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্য অংশীদারিত্ব থেকে কৌশলগত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বে রূপান্তর করতে আগ্রহী। ঢাকায় নিযুক্ত থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত থিতিপর্ন চিরাসাওয়াদি সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে এই আশার কথা জানিয়েছেন।

রাষ্ট্রদূত বলেন, “আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপনের গতিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হলো যত দ্রুত সম্ভব মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) আলোচনা শুরু করা এবং চূড়ান্ত করা।” গত এপ্রিল ২০২৪-এ FTA-এর জন্য একটি আগ্রহপত্র (LOI) স্বাক্ষরিত হয়েছিল।

FTA ও কানেক্টিভিটি হাব

রাষ্ট্রদূত চিরাসাওয়াদি মনে করেন, এই চুক্তি বিদ্যমান প্রায় ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণকে ছাড়িয়ে যেতে শুল্ক বাধাগুলো দূর করতে সহায়ক হবে। তিনি বাংলাদেশকে কেবল একটি বাজার হিসেবে নয়, বরং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সংযুক্ত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কানেক্টিভিটি হাব হিসেবে দেখছেন।

থাইল্যান্ডের ‘লুক ওয়েস্ট’ নীতির সাথে বাংলাদেশের ‘লুক ইস্ট’ নীতির সমন্বয় ঘটানোয় রাষ্ট্রদূত আশা করছেন, বাংলাদেশে থাই বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে—বিশেষত কৃষি-প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং লজিস্টিকস (সরবরাহ ব্যবস্থা) খাতে। তিনি বিশ্বাস করেন, এই গভীর অর্থনৈতিক সংহতি ও ভৌত সংযোগের দিকে পরিবর্তনই বাংলাদেশ-থাইল্যান্ড সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করবে, যা আগামী বছর বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের (LDC) তালিকা থেকে উত্তরণে সহায়তা করবে।

রাজনৈতিক চক্র নির্বিশেষে অবিচল অঙ্গীকার

রাষ্ট্রদূত জানান, একটি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও অংশীদার হিসেবে থাইল্যান্ড বাংলাদেশের জনগণের ও প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর আস্থা রাখে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “রাজনৈতিক চক্র নির্বিশেষে থাইল্যান্ড-বাংলাদেশ অংশীদারিত্বের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার অবিচল থাকবে।” একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আঞ্চলিক সংযোগের গতি বজায় রেখে তার অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে চলবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

তাৎক্ষণিক এজেন্ডা: উপকূলীয় নৌপথ স্থাপন

রাষ্ট্রদূত জানান, তাদের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল তাৎক্ষণিক এজেন্ডা হলো রানং বন্দর (থাইল্যান্ড) এবং চট্টগ্রাম বন্দরের মধ্যে সরাসরি উপকূলীয় শিপিং রুট প্রতিষ্ঠা করা। একবার সম্পূর্ণরূপে চালু হলে, এই রুটে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের সময় বর্তমান ১২-১৫ দিন থেকে কমে মাত্র ৩-৪ দিনে নেমে আসবে। এতে লজিস্টিক খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে এবং উভয় দেশের পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে।

এছাড়াও, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং হালাল শিল্পে উচ্চ সম্ভাবনা দেখছেন থাই রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, থাইল্যান্ডের খাদ্য প্রযুক্তির দক্ষতা এবং বাংলাদেশের বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার যৌথ উদ্যোগের জন্য লাভজনক ক্ষেত্র তৈরি করেছে। তারা জ্বালানি খাত এবং মেডিকেল ট্যুরিজমে সহযোগিতা বাড়াতেও আগ্রহী।

ব্লু ইকোনমি ও জলবায়ু-স্মার্ট উদ্যোগ

উভয় দেশই সামুদ্রিক রাষ্ট্র এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকায়, ব্লু ইকোনমি (নীল অর্থনীতি) হলো সহযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত থাইল্যান্ডের পোর্ট অথরিটি (রানং পোর্ট) এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মধ্যেকার সমঝোতা স্মারক (MOU) কার্যকর করার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এই সহযোগিতা টেকসই বন্দর ব্যবস্থাপনা, সবুজ লজিস্টিকস এবং উপকূলীয় সম্পদ সংরক্ষণে প্রসারিত হতে পারে।

থাইল্যান্ডের ‘বায়ো-সার্কুলার-গ্রিন (BCG) ইকোনমি’ মডেলের মাধ্যমে কৃষি ও শিল্পে স্থায়িত্ব বাড়াতে তারা তাদের দক্ষতা ভাগ করে নিতে প্রস্তুত। তারা জলবায়ু-স্মার্ট কৃষি এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে যৌথ উদ্যোগ শুরু করতে পারে।

বিমসটেক এবং আঞ্চলিক সংযোগ

বিমসটেক (BIMSTEC) প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত চিরাসাওয়াদি জানান, থাইল্যান্ড বাংলাদেশের বর্তমান চেয়ারপার্সনশিপকে সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করে এবং ‘প্রো বিমসটেক’ (PRO BIMSTEC) এজেন্ডার নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

তিনি উল্লেখ করেন, বিমসটেক মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল আলোচনা দ্রুত শেষ করতে থাইল্যান্ড ঢাকার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গঠনে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত ও কূটনৈতিক সহায়তা দেবে।

কানেক্টিভিটির বিষয়ে রাষ্ট্রদূত জানান, তারা বিমসটেক মাস্টার প্ল্যান ফর ট্রান্সপোর্ট কানেক্টিভিটি বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশের সাথে সমন্বয় করবে। তিনি জোর দেন যে, থাইল্যান্ড ত্রিপক্ষীয় মহাসড়ক এর সম্প্রসারণ এবং বাংলাদেশের সাথে এর সংযোগের জন্য গঠিত ওয়ার্কিং গ্রুপগুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে।

পিপল-টু-পিপল কানেকশন

রাষ্ট্রদূত মনে করেন, আঞ্চলিক সংযোগের জন্য জনগণের সাথে জনগণের সংযোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। থাই দূতাবাস মেডিকেল ট্যুরিজম, শিক্ষা-পর্যটন এবং স্কলারশিপ কর্মসূচিগুলোর মাধ্যমে পারস্পরিক বোঝাপড়া গভীর করতে চায়।

‘থাই কিচেন টু দ্য ওয়ার্ল্ড’ নীতির অধীনে বাংলাদেশে থাই ফুড প্রমোশন প্রজেক্টকে একটি আকর্ষণীয় উদ্যোগ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি জানান, খাদ্য কূটনীতির মাধ্যমে দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করা সম্ভব।

সুশাসন ও কারিগরি সহায়তা

সুশাসন সহযোগিতার ক্ষেত্রে থাইল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (TICA) মাধ্যমে কারিগরি সহায়তা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। তারা ই-গভর্ন্যান্স এবং পরিষেবা বিতরণে তাদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে প্রস্তুত। রাষ্ট্রদূত জানান, তারা সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও বিনিময় সফরের আয়োজন করতে পারে।

রাষ্ট্রদূত চিরাসাওয়াদি বলেন, “আমাদের পদ্ধতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং প্রেসক্রিপটিভ ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রযুক্তিগত জ্ঞান বিনিময়ের উপর নির্ভর করে।” তারা সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং জনসেবা উদ্ভাবনের মডিউল সহ-উন্নয়নে বাংলাদেশের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে অংশীদারিত্ব করতেও আগ্রহী বলে জানান।