ঢাকা : বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীরা দেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের সময়সীমা তিন বছর পিছিয়ে দেওয়ার জন্য সফররত জাতিসংঘের মিশনের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, এলডিসি-উত্তর পরিস্থিতিতে দেশের শিল্পকে স্থিতিশীল রাখতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায়েই নীতি সহায়তা অপরিহার্য।
কৌশলগত পরামর্শ সভা
এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে বাংলাদেশের প্রস্তুতি যাচাই করতে জাতিসংঘের এলডিসি-বিষয়ক কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক রোনাল্ড মোলেরুসের নেতৃত্বাধীন মিশন চার দিনের সফরে এখন ঢাকায় রয়েছে।
গতকাল সোমবার (১০ নভেম্বর ২০২৫) রাজধানীর গুলশানে ইউএন হাউসে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কৌশলগত পরামর্শ সভা করে জাতিসংঘ মিশন। এই ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-র সভাপতি মাহমুদ হাসান খান। বিজিএমইএ-র বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
শিল্পের ওপর চাপ ও ঝুঁকির কারণ
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বৈঠকে তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর বিদ্যমান চাপ ও দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকির দিকগুলি তুলে ধরেন:
- ক্রমবর্ধমান পরিচালন ব্যয়: ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গ্যাসের মূল্য ২৮৬ শতাংশ বেড়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসেও ক্যাপটিভ ও শিল্প খাতে গ্যাসের দাম যথাক্রমে ৪০% ও ৩৩.৩৩% বাড়ানো হয়েছে, যা উৎপাদন সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে।
- আর্থিক প্রতিবন্ধকতা: দেশে ২৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ এবং ব্যাংক সুদের হার ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় বেসরকারি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছে।
- অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ঝুঁকি: তিনি সতর্ক করে বলেন যে, দেশের শিল্পে তেমন বৈচিত্র্য না থাকা এবং কাঁচামালের আমদানিনির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় ঝুঁকি।
- ক্রয়াদেশ হ্রাস ও সমন্বয়হীনতা: আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্রয়াদেশ হ্রাসের প্রবণতা এবং এলডিসি উত্তরণ কৌশল বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতা নিয়ে তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, “ব্যাংক লুটপাট, উচ্চ সুদহারসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে বাংলাদেশের শিল্পকারখানা বর্তমানে আইসিইউতে আছে। এ অবস্থায় রোগীকে (শিল্প) সুস্থ অবস্থায় আনতে সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে; তা না হলে শিল্পকে বাঁচানো যাবে না। এমন উদাহরণ দিয়েই এলডিসি উত্তরণ পেছানোর অনুরোধ করেছি আমরা।”
ব্যবসায়ী নেতাদের সুনির্দিষ্ট সুপারিশ
এলডিসি উত্তরণকে স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে ব্যবসায়ী নেতারা সরকার ও উন্নয়ন অংশীদারদের জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ পেশ করেন:
| মেয়াদ | সুপারিশসমূহ |
| স্বল্প মেয়াদ | ১. ডব্লিউটিওর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিকল্প প্রণোদনা চালু করা। ২. ব্যাংক সুদের হার হ্রাস ও ইডিএফ (EDF) পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক চাপ কমানো। ৩. নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং লজিস্টিকস অদক্ষতা (বন্দর ও শুল্ক) দূর করা। |
| মধ্য মেয়াদ | ১. ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও খেলাপি ঋণ হ্রাস করা। ২. দ্রুত গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ। ৩. দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নে বিনিয়োগের মাধ্যমে শিল্পের কাঠামোগত ভিত্তি মজবুত করা। |
বিজিএমইএ সভাপতি আরও মত দেন যে, সফল এলডিসি উত্তরণের পর সকল উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের বাজারে কমপক্ষে তিন বছরের জন্য মসৃণ উত্তরণকাল (Smooth Transition Period) নিশ্চিত করা দরকার। এর পাশাপাশি শিল্পের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখা এবং পরিবেশবান্ধব রূপান্তরের জন্য স্বল্প সুদের মিশ্র অর্থায়ন এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার ভূমিকা অপরিহার্য।
সভায় বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ও নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, বাংলাদেশ টেরিটাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএমইএ) চেয়ারম্যান হোসেন মেহমুদ সহ অন্যান্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন।