বৃহস্পতিবার ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫
সর্বশেষ:
চট্রগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃক নতুন ট্রেডিং সময়সূচী প্রত্যাহারের দাবী জানিয়েছে, ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশন উদ্যোক্তা তৈরির জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় ’এসএমই’ উন্নয়ন নীতি ২০২৫’ তৈরি করছে একক ব্যক্তি ৪৫ লক্ষ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন বিআইএ নির্বাহী কমিটির নির্বাচন, ২০টি পদের জন্য ৩৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জব্দকৃত অ্যাকাউন্ট থেকে লুট হওয়া অর্থ উদ্ধারে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএফআই ইউ হত্যা ও গুমের অভিযোগে হাসিনার বিচার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যে একটি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম মুশফিকুর রহমান এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন হিসেবে যোগদান করেছেন জুনের মধ্যে গতি ফিরে পাবে শেয়ারবাজার: ডিএসই চেয়ারম্যান জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির উদ্বেগের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিগত হার বৃদ্ধির কথা ভাবছে

সেবাখাতে দুর্নীতি: টিআইবির জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩:

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp
Share on print

সার্বিকভাবে ৭০.৯ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার; ১৫ বছরে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ ১ লক্ষ ৪৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকা: টিআইবি

ঢাকা, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪:  মে, ২০২৩ থেকে এপ্রিল, ২০২৪ মেয়াদে সার্বিকভাবে ৭০.৯ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে এবং সেবাখাতে দেশের সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্থ খাত হলো- পাসপোর্ট, বিআরটিএ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা ও ভূমি খাত।

এ ছাড়া একই সময়ে সার্বিকভাবে ঘুষের শিকার হওয়া খানার হার ৫০.৮ শতাংশ। সর্বোচ্চ ঘুষ গ্রহণকারী তিনটি খাত হলোÑ পাসপোর্ট, বিআরটিএ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। “সেবাখাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩” এর ফলাফল প্রকাশে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ সকল তথ্য জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

টিআইবির জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই জরিপের মেয়াদকালে অন্যান্যসহ ১৮টি খাত বিবেচনায় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত পাঁচটি খাত হচ্ছে পাসপোর্ট (৮৬%), বিআরটিএ (৮৫.২%), আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (৭৪.৫%), বিচারিক সেবা (৬২.৩%) এবং ভ‚মি সেবা (৫১.০%)। জরিপে সার্বিকভাবে ঘুষের শিকার হওয়া খানার হার ৫০ দশমিক ৮ শতাংশ; এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ঘুষ গ্রহণকারী পাঁচটি খাত হচ্ছে পাসপোর্ট (৭৪.৮%), বিআরটিএ (৭১.৯%), আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (৫৮.৩%), বিচারিক সেবা (৩৪.১%), এবং ভ‚মি সেবা (৩২.৩%)। জরিপে অন্তর্ভুক্ত ঘুষদাতা খানার ৭৭ দশমিক ২ শতাংশ ঘুষ দেওয়ার কারণ হিসেবে ‘ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না’ – এ কথা বলেছেন, অর্থাৎ ঘুষ আদায়ের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া, ২০২৩ খানা জরিপে সার্বিকভাবে জাতীয় পর্যায়ে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার ৯০২ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের (সংশোধিত) ১.৪৩ শতাংশ এবং বাংলাদেশের জিডিপির ০.২২ শতাংশ। টিআইবির ২০১০ সাল থেকে পরিচালিত খানা জরিপে প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ন্যূনতম প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে অন্তর্ভুক্ত খাত/প্রতিষ্ঠানসমূহ হতে সেবা নিতে গিয়ে বাংলাদেশের খানাগুলো প্রায় ১ লক্ষ ৪৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছে।

টিআইবির এই জরিপে নির্বাচিত খানাগুলো ২০২৩ সালের মে থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে সেবা গ্রহণে বিভিন্ন সেবাখাতে যে সব দুর্নীতি ও হয়রানির সম্মুখীন হয়েছে তার ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এই খানা জরিপের তথ্য সংগ্রহের কাজ ২০২৪ সালের ১৩ মে থেকে ২০২৪ সালের ৩ আগষ্ট পর্যন্ত সময়ে ৬৪টি জেলায় পরিচালিত হয়।

জরিপে আরও দেখা যায়, দরিদ্র, নি¤œ আয় ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য দুর্নীতি একটি অন্যায্য বোঝা। নি¤œ আয়ের জনগোষ্ঠীর ওপর ঘুষ ও নিয়মবহিভর্‚ত অর্থের লেনদেনের প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি। যেসব খানার মাসিক আয় ২৪ হাজার টাকার কম তাদের বার্ষিক আয়ের শূন্য দশমিক ৯৩ শতাংশ ঘুষ হিসেবে খরচ করতে হয়, পক্ষান্তরে মাসিক আয় ৮৫ হাজার টাকার বেশি এমন খানার ক্ষেত্রে এ হার শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ। জরিপে আরও দেখা যায়, নারী, আদিবাসী, এবং প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের সেবা গ্রহণের জন্য দুর্নীতি ও ঘুষের শিকার হওয়ার অর্থ তাদের সীমিত আর্থ-সামাজিক সক্ষমতার ওপর অতিরিক্ত বোঝা বিদ্যমান, যা তাদের প্রান্তিকতাকে আরও বৃদ্ধি করছে। পুরুষ সেবাগ্রহীতার তুলনায় নারী সেবাগ্রহীতাদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য হারে বেশি দুর্নীতির শিকার হওয়ার ফলে এসব খাতে নারীদের অংশগ্রহণকে নিরুৎসাহিত করছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রগতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

দুর্নীতি প্রতিরোধের হাতিয়ারসমূহ বাংলাদেশে ব্যবহার হয় না উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা দেখে আসছি, “দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা” বিষয়টি শুধু ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কাগজে কলমে সরকার দুর্নীতি রোধের কথা বললেও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা প্রতিবেদনগুলো প্রত্যাখ্যাত হয়। যে প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর দুর্নীতি রোধের দায়িত্ব তাদের শুধু অকার্যকর নয়, বরং কর্মপরিধিও সীমিত করে রাখা হয়েছে। তা ছাড়া, উদ্বেগের সঙ্গে আমরা লক্ষ করছি যে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে সাধারণ জনগণ জিম্মি হয়ে দুর্নীতিকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। দুর্নীতির দায়ে যারা অভিযুক্ত নানা অনুষ্ঠান-আয়োজনে তাদেরকে সভাপতি-প্রধান অতিথির আসনে বসানো হয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সভাপতির মর্যাদা দেওয়া হয়। এই ধারা অব্যাহত থাকা প্রমাণ করে যে দুর্নীতিকে বিচারহীনতা প্রদানের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হচ্ছে, এ চিত্র আমাদের জন্য আশঙ্কাজনক। যারা দুর্নীতি করেন, তাদের অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। জরিপের বিশ্লেষণ অনুযায়ী জনগণের প্রত্যাশার শীর্ষেও তাই। এখন সেই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদে এ বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করা সম্ভব হলে তা অব্যাহত রাখতে পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকারের জন্য বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করতে পারে বলে আমরা মনে করি।’

জরিপে অনলাইনে ও মিশ্র পদ্ধতির (আংশিক অনলাইনে ও আংশিক সরাসরি উপস্থিত হয়ে) তুলনায় সরাসরি উপস্থিত হয়ে সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির শিকার হওয়ার হার বেশি দেখা যায়। তবে বিভিন্ন খাতে ডিজিটাল সেবার প্রচলন করা হলেও এসব খাতে দুর্নীতি ও ঘুষের হার থেকে বোঝা যায়, একদিকে ডিজিটাল সেবা ত্রæটিপূর্ণ এবং অন্যদিকে ডিজিটালাইজেশন এমনভাবে করা হয়েছে যেন সেবাগ্রহীতা মিশ্র পদ্ধতি ব্যবহার করতে এবং ঘুষ দিতে বাধ্য হয়, অর্থাৎ দুর্নীতি ও ঘুষের সুযোগ উন্মুক্ত থাকে।

গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে ড. জামান বলেন, ‘সরকারি বিভিন্ন সেবাগ্রহণ প্রক্রিয়া আংশিক ডিজিটালাইজেশনের কারণে সেবাখাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের কাঙ্খিত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। সেবাগ্রহীতাদের মিশ্র পদ্ধতিতে সেবা নিতে বাধ্য করা হচ্ছে, যার ফলে ঘুষ লেনদেনের সুযোগ বহাল রয়েছে। অনেকাংশে সেবাগ্রহীতাদের একাধিক পর্যায়ে ঘুষ দিতে হয়, কারণ অনেক কর্মকর্তা ঘুষ গ্রহণ করেও সেবা দেন না। সেবাগ্রহীতাদের যারা হয়রানি করে তাদের সিন্ডিকেট ভাঙ্গা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুদক অকার্যকর এটা সবাই জানেন। দুদকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করেন খুবই নগণ্য সংখ্যক মানুষ, মাত্র ০.৬ শতাংশ। এর কারণ অভিযোগ দায়ের করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অধিকাংশ নাগরিক ওয়াকিবহাল নন। অভিযোগ করেও প্রতিকার বা কোনো প্রতিক্রিয়াও পাওয়া যায় না, বরং অনেক সময় অভিযোগকারী হয়রানির শিকার হন। এভাবে, জবাবদিহিতার অভাবে দুর্নীতি ব্যাপকতা ও গভীরতা সংকটময় পর্যায়েই রয়ে যাচ্ছে।’

জরিপে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে নীতি-নির্ধারণী এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য টিআইবির সুপারিশমালার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ সেবাখাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অবস্থান ও পরিচয় নির্বিশেষে আইনানুগভাবে জবাবদিহি নিশ্চিত করা, এক্ষেত্রে বিভাগীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সক্রিয় ভ‚মিকা পালন; প্রযোজ্যক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতার সঙ্গে সেবাদাতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হ্রাসে সকল সেবা পুরোপুরি ডিজিটাইজ করা, সব খাতের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে ‘‘ওয়ান স্টপ’’ সার্ভিস চালু করা এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা; জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সেবাদানকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সেবাদাতার জন্য আচরণ বিধি প্রণয়ন ও কার্যকর করা;  বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবাদানের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পেশাগত মানদÐের ওপর ভিত্তি করে পদোন্নতি, পদায়নের ব্যবস্থা, অপরদিকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পদোন্নতি, পদায়ন ও পুরস্কার দেওয়া বন্ধ করা; সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণশুনানি ও সামাজিক নিরীক্ষার মতো জনগণের অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম নিশ্চিত করা ইত্যাদি।

আজ টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান, গবেষণার বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন প্রাক্তন অধ্যাপক ড. সেকান্দার হায়াত খান, পিকে. মো. মতিউর রহমান ও মোহাম্মদ শোয়ায়েব। টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের রিসার্চ ফেলো মোহাম্মদ নূরে আলম ও গবেষণা সহযোগী-কোয়ান্টিটেটিভ মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান সাখিদার।

জরিপের পূর্ণাঙ্গ ফলাফল, ইনফোগ্রাফ ও যাবতীয় নথিপত্রের জন্য ভিজিট করুন : https://www.ti-bangladesh.org/nhs  

আরও পড়ুন