ঢাকা, ২৯ জুলাই: মুদ্রানীতি বলতে একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক) কর্তৃক অর্থনীতিতে অর্থ ও ঋণের সরবরাহ প্রভাবিত করার জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে বোঝায়। মুদ্রানীতির মূল উদ্দেশ্য হলো সামষ্টিক অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা, যেমন:
- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ: মূল্যস্ফীতি কম ও স্থিতিশীল রাখা। এটি প্রায়শই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য, কারণ উচ্চ ও অস্থির মূল্যস্ফীতি ক্রয়ক্ষমতাকে ক্ষুণ্ণ করে এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করে।
- অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: টেকসই অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ এবং উচ্চ কর্মসংস্থান হার বৃদ্ধি করা।
- আর্থিক স্থিতিশীলতা: ব্যাংক ও আর্থিক বাজার সহ আর্থিক ব্যবস্থার স্বাস্থ্য ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।
- বিনিময় হার স্থিতিশীলতা: অন্যান্য মুদ্রার সাপেক্ষে দেশীয় মুদ্রার মূল্য পরিচালনা করা (কিছু দেশের জন্য)।
মুদ্রানীতি যেভাবে কাজ করে:
কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো অর্থনীতিতে অর্থের সহজলভ্যতা ও ব্যয় সমন্বয় করে মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করে। তারা মূলত বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে সুদের হার, ব্যাংক ঋণ এবং সামগ্রিক অর্থ সরবরাহকে প্রভাবিত করে। এই পদক্ষেপগুলো যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে, তাকে মুদ্রা সংক্রমণ প্রক্রিয়া (Monetary Transmission Mechanism) বলা হয়।
মুদ্রানীতির মূল উপকরণসমূহ:
যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকভেদে নির্দিষ্ট উপকরণগুলো কিছুটা ভিন্ন হতে পারে, তবে সবচেয়ে সাধারণ উপকরণগুলো হলো:
১. নীতি সুদহার (Policy Rates):
- রেপো রেট (Repo Rate): এটি সেই সুদের হার, যে হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদের প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারি সিকিউরিটিজ জামানত রেখে অর্থ ধার করে। রেপো রেট বাড়ালে ব্যাংকগুলোর জন্য ঋণ নেওয়া ব্যয়বহুল হয়, যার ফলে ব্যবসা এবং ভোক্তাদের জন্য ঋণের হার বেড়ে যায়, যা অর্থের সরবরাহকে সংকুচিত করে। বিপরীতে, রেপো রেট কমালে ঋণ সস্তা হয়।
- রিভার্স রেপো রেট (Reverse Repo Rate): এটি সেই হার, যে হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ ধার করে। এটি ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে অতিরিক্ত তারল্য শোষণে সহায়তা করে।
- স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (SLF) / মার্জিনাল লেন্ডিং রেট: এটি সেই হার, যে হারে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রাতারাতি তহবিল ধার করতে পারে।
- স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (SDF) / ডিপোজিট রেট: এটি সেই হার, যে হারে ব্যাংকগুলো তাদের অতিরিক্ত রিজার্ভ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে পারে। এই হারগুলো প্রায়শই একটি “সুদের হার করিডর” তৈরি করে যার মধ্যে আন্তঃব্যাংক ঋণের হার ওঠানামা করে।

২. খোলা বাজার কার্যক্রম (Open Market Operations – OMOs):
- এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলা বাজারে সরকারি সিকিউরিটিজ (বন্ড) ক্রয় বা বিক্রয় করে।
- সিকিউরিটিজ ক্রয়: কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন সিকিউরিটিজ ক্রয় করে, তখন এটি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অর্থ প্রবেশ করায়, ব্যাংকের রিজার্ভ বাড়ায় এবং এর ফলে ঋণের জন্য উপলব্ধ অর্থ বৃদ্ধি পায়। এটি একটি সম্প্রসারণমূলক পদক্ষেপ।
- সিকিউরিটিজ বিক্রয়: কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন সিকিউরিটিজ বিক্রি করে, তখন এটি ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে অর্থ তুলে নেয়, ব্যাংকের রিজার্ভ এবং ঋণের জন্য উপলব্ধ অর্থ হ্রাস করে। এটি একটি সংকোচনমূলক পদক্ষেপ।
৩. সংরক্ষিত তারল্যের প্রয়োজনীয়তা (Reserve Requirements):
- এটি মোট জমার একটি শতাংশ যা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আইনত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বা তাদের ভল্টে রিজার্ভ হিসেবে রাখতে হয়, ঋণ দেওয়ার পরিবর্তে।
- সংরক্ষিত তারল্যের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি: ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার জন্য উপলব্ধ অর্থের পরিমাণ হ্রাস করে, ফলে অর্থের সরবরাহ সংকুচিত হয়।
- সংরক্ষিত তারল্যের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস: ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার জন্য আরও অর্থ মুক্ত করে, ফলে অর্থের সরবরাহ প্রসারিত হয়। এই উপকরণটি সাধারণত কম ব্যবহৃত হয় কারণ এর একটি খুব তীব্র এবং বিঘ্ন সৃষ্টিকারী প্রভাব থাকতে পারে।
৪. ডিসকাউন্ট রেট (Discount Rate):
- এটি সেই সুদের হার, যে হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারে (যা “ডিসকাউন্ট উইন্ডো” নামে পরিচিত)। খোলা বাজার কার্যক্রমের চেয়ে কম ব্যবহৃত হলেও, ডিসকাউন্ট রেটের পরিবর্তন মুদ্রানীতির বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থান নির্দেশ করতে পারে।
৫. ফরওয়ার্ড গাইডেন্স (Forward Guidance):
- কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের ভবিষ্যতের নীতিগত উদ্দেশ্যগুলো জনসমক্ষে এবং আর্থিক বাজারগুলোতে যোগাযোগ করে। এটি ভবিষ্যতের সুদের হার এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বাজারের প্রত্যাশাকে আকার দিতে সহায়তা করে, যা বর্তমান অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোকে প্রভাবিত করে।
৬. গুণগত উপকরণ (Qualitative Tools):
- এতে নৈতিক প্ররোচনা (ব্যাংকগুলোকে নির্দিষ্ট ঋণ অনুশীলন অনুসরণ করতে রাজি করানো) এবং নির্বাচিত ঋণ নিয়ন্ত্রণ (নির্দিষ্ট খাতে ঋণকে নির্দেশিত করা বা দূরে রাখা) এর মতো পদক্ষেপগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে।
মুদ্রানীতির প্রকারভেদ:
- সম্প্রসারণমূলক (Loose) মুদ্রানীতি: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উদ্দীপিত করা, বেকারত্ব কমানো এবং মুদ্রাস্ফীতি রোধ করা এর লক্ষ্য। এতে সুদের হার কমানো, সরকারি সিকিউরিটিজ কেনা এবং সংরক্ষিত তারল্যের প্রয়োজনীয়তা কমানোর মতো পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত থাকে।
- সংকোচনমূলক (Tight) মুদ্রানীতি: মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং একটি উত্তপ্ত অর্থনীতিকে শীতল করা এর লক্ষ্য। এতে সুদের হার বাড়ানো, সরকারি সিকিউরিটিজ বিক্রি করা এবং সংরক্ষিত তারল্যের প্রয়োজনীয়তা বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত থাকে।
বাংলাদেশে, বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য দায়ী। এর মুদ্রানীতি বিবৃতি (Monetary Policy Statements – MPS) তাদের অবস্থান এবং মূল লক্ষ্য অর্জনের কৌশলগুলো তুলে ধরে, প্রাথমিকভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার উপর মনোযোগ দেয়।