মঙ্গলবার ২৮ অক্টোবর, ২০২৫
সর্বশেষ:
হালাল পণ্য রপ্তানি বাড়াতে বাংলাদেশ-পাকিস্তান চুক্তি: বিএসটিআই সনদ পাবে পাকিস্তানে স্বীকৃতি জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিলুপ্ত করবে বিএনপি: আমীর খসরু হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ডের ৫ নম্বর কূপে ওয়ার্কওভার কাজ শুরু: উৎপাদন বাড়বে ১৫ মিলিয়ন ঘনফুট ডিসিসিআই আলোচনায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য ‘স্মার্ট মানবসম্পদ’ উন্নয়নে জোর মানব পাচার, অস্থিতিশীলতায় বাংলাদেশের পাসপোর্টের উপর বৈশ্বিক আস্থায় সংকট নির্বাচন ২০২৬: অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইসির বৈঠক ৩০ অক্টোবর ৪,৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ: ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের গ্রাহকদের টাকা উদ্ধারের দাবি<gwmw style="display:none;"></gwmw> মতিঝিল ও গুলশানে দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ২০ শতাংশ, ভাসানটেকে সর্বনিম্ন শপথ নিলেন পেট্রোবাংলা অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের নবনির্বাচিত নেতৃত্ব

মানব পাচার, অস্থিতিশীলতায় বাংলাদেশের পাসপোর্টের উপর বৈশ্বিক আস্থায় সংকট

ঢাকা: গত এক বছরে ভিসা নিষেধাজ্ঞা, গণহারে ফেরত পাঠানো এবং বিশ্বব্যাপী আস্থার সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের গতিশীলতা ও মর্যাদা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলস্বরূপ, বিশ্বজুড়ে দুর্বলতম পাসপোর্টগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের স্থান আরও নিচে নেমে এসেছে।

ইউকে-ভিত্তিক হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স কর্তৃক গত ১৪ অক্টোবর প্রকাশিত ২০২৫ সালের হেনলি পাসপোর্ট সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশ ১০৬টি দেশের মধ্যে ১০০তম অবস্থানে নেমে এসেছে, যার ফলে এটি বিশ্বের সপ্তম দুর্বলতম পাসপোর্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বাংলাদেশ এই অবস্থানে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে রয়েছে, যেখানে ফিলিস্তিন এক ধাপ এগিয়ে ৯৯তম স্থানে আছে।

বর্তমানে বাংলাদেশি নাগরিকেরা মাত্র ৩৮টি দেশে ভিসা-মুক্ত প্রবেশাধিকার পান। তবে অনেক যাত্রী বলছেন, ভিসা-মুক্ত গন্তব্যগুলোতেও এখন ক্রমবর্ধমান হারে ভিসা প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে এবং স্ক্রুটিনি বা যাচাই-বাছাই বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একটি পাসপোর্টের মর্যাদা নির্ভর করে একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা, উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা, কূটনৈতিক সম্পর্ক, ভিসা চুক্তি, সাংস্কৃতিক বা ঐতিহাসিক সংযোগ এবং অনিয়মিত অভিবাসনের ধরনের ওপর।

ভিসা বিধিনিষেধ ও কূটনৈতিক টানাপোড়েন

ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে শাসনতান্ত্রিক ব্যর্থতা, মানব পাচার কেলেঙ্কারি এবং কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েনকে এই পতনের কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

পরিবর্তনের পর থেকে বাংলাদেশের বৃহত্তম ভ্রমণ গন্তব্য ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তীব্রভাবে খারাপ হয়েছে। ভারত ‘নিরাপত্তা উদ্বেগের’ কারণ দেখিয়ে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে তাদের সব ভিসা কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়, যদিও পরে সীমিত পরিসরে মেডিকেল এবং স্টুডেন্ট ভিসা পরিষেবা পুনরায় চালু হয়েছে।

অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য আগমনের আগে ইলেকট্রনিক ট্রাভেল অথরাইজেশন (ইটিএ) বাধ্যতামূলক করেছে। এছাড়া, সৌদি আরব ২০২৫ সালের মে মাসে বাংলাদেশ এবং আরও ১৩টি দেশের জন্য কাজের ভিসা স্থগিত করেছে।

ডেনমার্ক এবং মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনামসহ বেশ কয়েকটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশও বাংলাদেশি আবেদনকারীদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া কঠোর করেছে। যাত্রীরা অভিযোগ করছেন, বৈধ ভিসা থাকা সত্ত্বেও তাদের দীর্ঘ সময় ধরে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে, ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার বেড়েছে এবং ইমিগ্রেশন চেকপয়েন্ট থেকে তাদের ‘অফলোডিং’ করা হচ্ছে।

সংকট গভীর হচ্ছে: গণহারে ফেরত পাঠানো

সাম্প্রতিক সময়ে নথিবিহীন বাংলাদেশিদের গণহারে ফেরত পাঠানোর ঘটনা দেশের পাসপোর্টের সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

  • ৮ সেপ্টেম্বর, কিরগিজস্তান ১৮০ জন অনিবন্ধিত বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠিয়েছে, যারা মানব পাচারের শিকার হয়েছিলেন।
  • একই মাসের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩০ জনকে ফেরত পাঠানো হয়।
  • ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে কমপক্ষে ১৮৭ জন বাংলাদেশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত এসেছেন।
  • গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরের শেষে ইতালি, অস্ট্রিয়া, গ্রিস এবং সাইপ্রাস থেকে আরও ৫২ জন বাংলাদেশি নাগরিককে ফেরত পাঠানো হয়।
  • ৩০ আগস্ট, যুক্তরাজ্য অভিবাসন লঙ্ঘনের জন্য ১৫ জনকে ফেরত পাঠায়।
  • এর আগে মালয়েশিয়া ১৫ আগস্ট ৯৮ জন বাংলাদেশি নাগরিককে ফেরত পাঠিয়েছিল, যার আগে আরও ২০৪ জনকে পাঠানো হয়েছিল।

মানব পাচার ও আস্থার সংকট

বিশ্লেষকরা বলছেন, অনিয়মিত অভিবাসন এবং মানব পাচারের উত্থানের সঙ্গে এই ব্যর্থতাগুলো সরাসরি বাংলাদেশের পাসপোর্টের মূল্যহ্রাস এবং বিদেশে বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাসে অবদান রেখেছে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০২৫ সালের ট্র্যাফিকিং ইন পারসনস (টিআইপি) রিপোর্টে বাংলাদেশ আবারো ‘টিয়ার ২’ (Tier 2)-এ স্থান পেয়েছে। রিপোর্টে মানব পাচার মোকাবিলায় সীমিত অগ্রগতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে গত বছর ৩,৪১০ জন বাংলাদেশি ভুক্তভোগীর নথিভুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে ৭৬৫ জন যৌন পাচারের, ২,৫৭২ জন জোরপূর্বক শ্রমের এবং ৭৩ জন অন্যান্য ধরনের শোষণের শিকার হন। তবে সরকারি হিসাবে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১,৪৬২ জন।

এছাড়াও, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্যমতে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুন মাসের মধ্যে গণপিটুনিতে ১৭৯ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৯ আগস্ট রংপুরের তারাগঞ্জে দু’জনকে পিটিয়ে হত্যার মতো কয়েকটি ঘটনা দেশকে নাড়া দিয়েছে।

জুলাই মাসে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, তার কাছে লাল অফিশিয়াল পাসপোর্ট থাকা সত্ত্বেও বিদেশে সন্দেহজনক দৃষ্টির মুখোমুখি হতে হয়েছে, কারণ তিনি বাংলাদেশি। তিনি যোগ করেন যে, তিনি যখন নিয়মিত সবুজ পাসপোর্ট ব্যবহার করেন, তখন চ্যালেঞ্জগুলো ‘আরও খারাপ’ হয়।

একই অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন স্বীকার করেন, বিদেশিদের হয়রানির সম্মুখীন হতে হয় এবং পাসপোর্টের মূল্য হ্রাসের জন্য বিদেশি কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি এটি আংশিকভাবে জাতির নিজস্ব দায়িত্ব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আইনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের পাসপোর্টের মান কমে যাওয়ার দুটি প্রধান কারণ রয়েছে।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, “প্রযুক্তিগতভাবে, আমাদের ই-পাসপোর্ট বৈশ্বিক ডাটাবেসের সঙ্গে ভালোভাবে সমন্বিত নয়—এটি পাঠযোগ্য কিন্তু সম্পূর্ণ অভিযোজিত বা উন্নত নয়, ফলে বাংলাদেশিরা স্বয়ংক্রিয় অভিবাসন ব্যবস্থা ব্যবহার করতে পারে না।”

তিনি আরও বলেন, “এছাড়াও, রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর অনেকের মধ্যে বিদেশে অভিবাসনের প্রবণতা দেখা গেছে। অনেকে তাদের পাসপোর্টের অপব্যবহার করেছেন বা অবৈধভাবে ব্যবহার করেছেন, জালিয়াতি করেছেন বা মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন।”

অধ্যাপক আইনুল ইসলাম বলেন, ২৪ জুলাইয়ের পর থেকে বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশিদের সংখ্যা অতীতের তুলনায় অনেক বেশি। “এইসব ঘটনার কারণে বেশ কয়েকটি দেশ সতর্ক হয়ে উঠেছে এবং বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রবেশ সীমিত করছে।” তিনি যোগ করেন, “শ্রীলঙ্কা ও নেপালেও একই ধরনের প্রবণতা দেখা যাওয়ায় এই অঞ্চলের ভাবমূর্তি খারাপ হয়েছে। ফলে ঢাকার বেশ কয়েকটি দূতাবাস বাংলাদেশি পাসপোর্ট গ্রহণ করা বন্ধ করে দিয়েছে।” “এই বৃহত্তর আঞ্চলিক প্রবণতা পাসপোর্টের মান হ্রাসে অবদান রেখেছে, কারণ দেশগুলো এই অঞ্চলের ভ্রমণকারীদের গ্রহণ করতে ক্রমবর্ধমানভাবে দ্বিধাগ্রস্ত।”